🧾 এজাহার বা প্রথমিক তথ্য বিবরণী (F.I.R.) কী: আইনগত বিশ্লেষণ ও সাধারণ মানুষের জন্য সহজ ব্যাখ্যা

লেখক: নাজমুল আলম অপু, এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

🔹 ভূমিকা

বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় “এজাহার” বা “প্রথমিক তথ্য বিবরণী (First Information Report – F.I.R.)” একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এটি হলো সেই প্রথম নথি, যার ওপর ভিত্তি করে পুলিশের তদন্ত শুরু হয়।
অনেক সময় দেখা যায়, সাধারণ মানুষ জানেন না এজাহার আসলে কী, কখন দিতে হয়, বা কিভাবে পুলিশ তা গ্রহণ করে। ফলে অনেক অপরাধের যথাযথ তদন্ত শুরুই হয় না।
এই লেখায় আমরা আইনগত ভাষায় এবং সহজভাবে ব্যাখ্যা করবো — এজাহারের সংজ্ঞা, আইনি ভিত্তি, Police Regulations, Bengal (PRB)-এর নিয়ম ২৩৪-এর ব্যাখ্যা, এবং সাধারণ মানুষের জন্য ব্যবহারিক দিক।

🔹 ১. এজাহার (F.I.R.) এর সংজ্ঞা

➤ আইনি সংজ্ঞা (CrPC ধারা ১৫৪ অনুযায়ী)

বাংলাদেশের দণ্ডবিধি কার্যবিধি (Code of Criminal Procedure, 1898)–এর ধারা ১৫৪ অনুযায়ী:

“Every information relating to the commission of a cognizable offence, if given orally to an officer in charge of a police station, shall be reduced to writing by him or under his direction and shall be read over to the informant…”

অর্থাৎ,
যখন কোনো ব্যক্তি পুলিশের থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে মৌখিক বা লিখিতভাবে এমন তথ্য দেন যা একটি cognizable offence (গ্রহণযোগ্য অপরাধ)–এর সাথে সম্পর্কিত, তখন সেই তথ্য লিখিত আকারে রেকর্ড করতে হবে এবং সেটিই First Information Report (F.I.R.) বা প্রথমিক তথ্য বিবরণী।

➤ বাংলা ব্যাখ্যা:

এজাহার হলো এমন একটি লিখিত বা মৌখিক প্রতিবেদন, যা পুলিশের কাছে প্রথমবার দেওয়া হয় কোনো গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সংবাদ হিসেবে, এবং যার ভিত্তিতে পুলিশ আইনগত তদন্ত শুরু করে।

🔹 ২. Police Regulations, Bengal (PRB), ১৯৪৩–এর Rule ২৩৪ অনুযায়ী এজাহারের ধারণা

PRB-এর নিয়ম ২৩৪-এ স্পষ্টভাবে বলা আছে:

“Every information relating to the commission of a cognizable offence given at a police station shall be entered in the First Information Report Register, Form No. 27, and shall be signed or sealed by the informant.”

➤ সরলভাবে বলা যায়:

• থানায় কেউ যদি এমন তথ্য দেন যা একটি cognizable offence সম্পর্কিত,
• তাহলে সেই তথ্য অবশ্যই F.I.R. রেজিস্টারে (Form No. 27) লিপিবদ্ধ করতে হবে,
• এবং তথ্যদাতাকে (informant) তাতে স্বাক্ষর করতে হবে।

এটি হলো সেই অফিসিয়াল দলিল যা প্রমাণ করে যে অপরাধের বিষয়ে পুলিশের কাছে প্রথম তথ্য এসেছে।

🔹 Rule ২৩৪-এর মূল উদ্দেশ্য হলো পুলিশ প্রশাসনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং তদন্তের শুরুর একটি আইনি ভিত্তি তৈরি করা।

🔹 ৩. এজাহারের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য

• এটি তদন্ত শুরুর ভিত্তি।
• F.I.R.-এর মাধ্যমে পুলিশ জানতে পারে কোথায়, কবে, কীভাবে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে এবং অভিযুক্ত কারা হতে পারে।
• এটি আদালতে প্রাথমিক প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় — বিশেষ করে ঘটনার সময়, স্থান ও পরিস্থিতি যাচাইয়ে।
• তবে মনে রাখতে হবে, F.I.R. কোনো প্রমাণমূলক দলিল নয়, বরং এটি একটি তদন্তের সূচনা বিন্দু।

🔹 ৪. F.I.R. ও জিডি (GD)-এর পার্থক্য

বিষয়	F.I.R. (এজাহার)	G.D. (General Diary)
আইনি ভিত্তি	CrPC ধারা ১৫৪	PRB নিয়ম ৩৮৮
অপরাধের ধরন	Cognizable offence (যেমন হত্যাচেষ্টা, চুরি, ডাকাতি)	Non-cognizable offence (যেমন হুমকি, হারানো জিনিস, ছোটখাটো বিবাদ)
তদন্ত	পুলিশ তৎক্ষণাৎ তদন্ত শুরু করতে পারে	তদন্তের আগে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদন প্রয়োজন
গুরুত্ব	এটি ফৌজদারি মামলার সূচনা করে	শুধুমাত্র রেকর্ড হিসেবে রাখা হয়

🔹 ৫. এজাহার দেওয়ার নিয়ম ও পদ্ধতি

ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা:

1. ঘটনা ঘটলে দ্রুত থানায় যান।
   বিলম্ব না করে থানার অফিসার-ইন-চার্জ (O.C.)-এর কাছে মৌখিক বা লিখিতভাবে জানান।
2. ঘটনার বিবরণ দিন।
   কোথায়, কখন, কীভাবে, কারা জড়িত — এই বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে বলুন।
3. লিখিত রেকর্ড ও স্বাক্ষর দিন।
   O.C. বা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সেটি লিখে আপনাকে পড়ে শুনাবেন, এরপর আপনি স্বাক্ষর বা আঙুলের ছাপ দিবেন।
4. F.I.R. রেজিস্টারে (Form No. 27) এন্ট্রি করা হবে।
   এটি PRB Rule 234 অনুযায়ী বাধ্যতামূলক।

🔹 ৬. কোন অপরাধে F.I.R. দেওয়া যায়

নিম্নলিখিত অপরাধগুলো সাধারণত Cognizable offence, অর্থাৎ যেখানে F.I.R. দিতে হয়:

• খুন, খুনের চেষ্টা
• ধর্ষণ, অপহরণ
• ডাকাতি, ছিনতাই
• গুরুতর শারীরিক আঘাত
• আগুন লাগানো, বিস্ফোরণ
• সরকারি কাজে বাধা বা আক্রমণ

অন্যদিকে non-cognizable offences-এর ক্ষেত্রে (যেমন হালকা মারধর, মানহানি ইত্যাদি) F.I.R. নয়, সাধারণত জিডি হয়।

🔹 ৭. F.I.R. দিতে দেরি হলে কী হয়

CrPC-এর ধারা ৫৬১A অনুযায়ী:

“Mere delay in lodging the First Information Report shall not be a ground for quashing the proceedings.”

অর্থাৎ, শুধু দেরি হওয়া মানেই মামলা বাতিল নয়।
তবে যথাযথ কারণ ব্যাখ্যা করলে আদালত সেটি গ্রহণ করে। যেমন —

• ভিকটিম অসুস্থ ছিলেন,
• ভয় পেয়েছিলেন,
• দূরবর্তী থানায় যেতে সময় লেগেছে ইত্যাদি।

🔹 ৮. মিথ্যা বা বিকৃত তথ্য দিলে শাস্তি

বাংলাদেশ দণ্ডবিধি (Penal Code, 1860) অনুযায়ী:

• ধারা ১৮২: সরকারি কর্মচারীকে ভুল পথে পরিচালিত করার জন্য মিথ্যা তথ্য দিলে ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানা।
• ধারা ২১১: মিথ্যা অপরাধমূলক অভিযোগ আনলে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড।

সুতরাং, F.I.R.-এ সত্য ও নির্ভুল তথ্য দেওয়া নাগরিক দায়িত্ব।

🔹 ৯. F.I.R. না নিলে করণীয়

অনেক সময় দেখা যায় পুলিশ F.I.R. নিতে চায় না বা বিলম্ব করে।
এই পরিস্থিতিতে করণীয়:

1. লিখিত অভিযোগসহ থানার O.C.-এর কাছে আবেদন করুন।
2. না হলে, উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা (SP বা DMP Commissioner)-এর কাছে লিখিত অভিযোগ দিন।
3. তাতেও প্রতিকার না হলে, CrPC ধারা ১৯০ অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগ দাখিল করতে পারেন।
   → ম্যাজিস্ট্রেট প্রাথমিক তদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন।

🔹 ১০. আদালতের দৃষ্টিভঙ্গি ও গুরুত্বপূর্ণ রায়

বাংলাদেশের হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন রায়ে F.I.R.-এর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

• State vs. Nur Hossain (42 DLR 254)
  আদালত বলেছেন: “F.I.R. is not an encyclopaedia of the case but only the first information to set the law in motion.”
  অর্থাৎ F.I.R.-এর উদ্দেশ্য হলো আইনগত প্রক্রিয়া চালু করা, পুরো ঘটনার বিশদ বিবরণ নয়।
• Abdul Jalil vs. State (44 DLR 333)
  রায়ে বলা হয়, যদি পুলিশ কোনো কারণে F.I.R. না নেয়, তাহলে আদালতের মাধ্যমে তা গ্রহণযোগ্য করা যায়।

🔹 ১১. F.I.R. সংশোধন বা বাতিলের নিয়ম

F.I.R. একবার নিবন্ধিত হলে তা সহজে বাদ দেওয়া যায় না।
তবে যদি ভুল তথ্য বা ভুল নাম যুক্ত হয়ে থাকে, তা তদন্ত কর্মকর্তা বা আদালতের অনুমোদনে সংশোধন করা সম্ভব।

আর যদি প্রমাণিত হয় যে অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা বা ভিত্তিহীন, তখন F.I.R. বাতিলের (quash) আবেদন করা যায় হাইকোর্টে, CrPC ধারা ৫৬১A অনুযায়ী।

🔹 ১২. সাধারণ নাগরিকের করণীয় ও পরামর্শ

• সবসময় লিখিতভাবে অভিযোগ দিন, যাতে ভবিষ্যতে প্রমাণ থাকে।
• F.I.R. দেওয়ার সময় তারিখ, সময় ও ঘটনার বিবরণ স্পষ্টভাবে লিখুন।
• পুলিশের কপি পাওয়ার চেষ্টা করুন, F.I.R. নম্বর নোট করুন।
• পুলিশের আচরণে অসন্তুষ্ট হলে Police Complaint Cell বা Human Rights Commission-এ যোগাযোগ করুন।

🔹 ১৩. একটি বাস্তব উদাহরণ

ধরা যাক, রফিকুল ইসলাম রাতের বেলায় নিজের দোকানে চুরি হয়েছে দেখে থানায় যান।
তিনি থানার O.C.-কে বলেন — দোকানের তালা ভেঙে কিছু মালামাল চুরি হয়েছে।

🔸 পুলিশ কর্মকর্তার দায়িত্ব:

• ঘটনার সময়, স্থান, চুরি হওয়া জিনিসের বিবরণ লিখে রাখা।
• রফিকুলকে পড়ে শোনানো ও তার সাইন নেয়া।
• F.I.R. রেজিস্টার (Form-27)-এ রেকর্ড করা (PRB Rule 234 অনুযায়ী)।
• এরপর তদন্ত শুরু করা ও তদন্তকারী অফিসার নিয়োগ।

এইভাবে F.I.R.-এর মাধ্যমে আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়।

---

🔹 ১৪. এজাহারের সামাজিক গুরুত্ব

• সাধারণ মানুষ যাতে ভয় ছাড়া অপরাধের খবর দিতে পারেন, সেটিই F.I.R.-এর মূল উদ্দেশ্য।
• এটি নাগরিক অধিকার রক্ষার প্রথম ধাপ — কারণ অপরাধের রিপোর্ট না হলে বিচারই শুরু হয় না।
• তাই F.I.R. হলো রাষ্ট্র, পুলিশ ও নাগরিকের মধ্যে ন্যায়ের প্রথম সেতুবন্ধন।

🔹 উপসংহার

এজাহার বা F.I.R. হলো ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র।
এটি কেবল একটি নথি নয়, বরং ন্যায়বিচারের সূচনা বিন্দু।
CrPC ধারা ১৫৪ ও Police Regulations, Bengal-এর Rule ২৩৪ আমাদের বলে দেয় — যেকোনো cognizable offence-এর খবর পুলিশ গ্রহণ ও রেকর্ড করতে বাধ্য।

অতএব, অপরাধের শিকার হলে ভয় না পেয়ে দ্রুত থানায় যান, সত্য তথ্য দিন, এবং নিজের অধিকার রক্ষায় আইনকে সঙ্গে রাখুন।
কারণ একটি সঠিক এজাহার-ই পারে আপনাকে ন্যায়বিচারের পথে এগিয়ে দিতে।

📜 লেখক:
নাজমুল আলম অপু
এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
📞 মোবাইল: ০১৭১৫-৯৯০৭৪১ | ০১৬৮০-১৯১৯৯১

---