---

📜 ইনজাংশন (Injunction): বাংলাদেশি আইন ও হাইকোর্ট রুলের আলোকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ

✍️ লেখক: নাজমুল আলম অপু, আইনজীবী ও আইনি ব্লগার

---

🔹 ভূমিকা

বাংলাদেশের দেওয়ানী বিচার ব্যবস্থায় ইনজাংশন (Injunction) একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ন্যায়বিচারমূলক প্রতিকার (Equitable Remedy)। এটি আদালতের এমন একটি নির্দেশ, যার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কোনো কাজ করতে বা করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করা হয়। এর উদ্দেশ্য হলো—

“ক্ষতি হওয়ার আগেই সেটি প্রতিরোধ করা।”

অর্থাৎ, ইনজাংশনের মূল দর্শন হচ্ছে “Preventive Justice”—যেখানে আদালত ক্ষতি ঘটার পর ক্ষতিপূরণ নয়, বরং ক্ষতি ঘটার আগেই আইনগত সুরক্ষা প্রদান করে।

বাংলাদেশে প্রতিদিন অসংখ্য দেওয়ানী মামলা দায়ের হয়—সম্পত্তি বিরোধ, চুক্তি লঙ্ঘন, কপিরাইট লঙ্ঘন, কোম্পানি শেয়ার নিয়ে দ্বন্দ্ব ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে, আদালত প্রায়ই ইনজাংশনের মাধ্যমে অস্থায়ী বা স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে থাকে যাতে কোনো পক্ষ অপর পক্ষের ক্ষতি করতে না পারে।

---

⚖️ ইনজাংশনের ধারণাগত ভিত্তি

ইনজাংশনের মূল ভিত্তি আসে Equity Jurisprudence থেকে, যা ব্রিটিশ কমন ল’ থেকে উদ্ভূত। Equity Courts-এ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য এমন প্রতিকার দেওয়া হতো, যা সাধারণ আইন (Common Law) দিতে পারত না।
বাংলাদেশের দেওয়ানী আদালত এখন সেই একই ধারণা অনুসরণ করে।

ইনজাংশন এক ধরনের discretionary relief, অর্থাৎ আদালত আবেদনকারীকে এই প্রতিকার তখনই দেয় যখন তার আচরণ ও উদ্দেশ্য ন্যায্য ও সৎ (Clean hands doctrine) হয়।

---

🧾 ইনজাংশনের আইনগত ভিত্তি

বাংলাদেশে ইনজাংশনের বিধান একাধিক আইনে বিদ্যমান, তবে প্রধানত তিনটি আইনে এর বিস্তৃত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়—

১️⃣ Civil Procedure Code, 1908 (CPC)

• Sections 94, 95 ও 151 — আদালতের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা (Inherent Powers) নির্ধারণ করে।
• Order XXXIX Rules 1 ও 2 — অন্তর্বর্তীকালীন (Temporary) ও অ্যাড-ইন্টারিম (Ad-interim) ইনজাংশনের বিস্তারিত বিধান।

এই ধারাগুলির মাধ্যমে আদালত কোনো পক্ষকে নির্দেশ দিতে পারে—

যেন সে কোনো সম্পত্তি বিক্রি, হস্তান্তর বা দখল পরিবর্তন না করে; কিংবা কোনো ক্ষতিকর কাজ থেকে বিরত থাকে।

---

২️⃣ Specific Relief Act, 1877

এই আইন স্থায়ী (Permanent) ও বাধ্যতামূলক (Mandatory) ইনজাংশনের বিধান নির্ধারণ করে।

• Section 53 — কখন ইনজাংশন দেওয়া যাবে না।
• Section 54 — স্থায়ী ইনজাংশনের শর্তাবলী।
• Section 55 — বাধ্যতামূলক ইনজাংশনের বিধান।
• Section 56–57 — বিশেষ পরিস্থিতিতে সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ।

---

৩️⃣ Special Laws

ইনজাংশন এখন শুধু দেওয়ানী মামলাতেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং অনেক বিশেষ আইনে এর প্রয়োগ রয়েছে—

• Trademark Act, 2009 — ট্রেডমার্ক লঙ্ঘন রোধে।
• Copyright Act, 2000 — কপিরাইট সুরক্ষায়।
• Companies Act, 1994 — শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থে।
• Transfer of Property Act, 1882 — প্রতারণামূলক সম্পত্তি হস্তান্তর রোধে।
• Environment Conservation Act, 1995 — পরিবেশের ক্ষতি রোধে ইনজাংশন।

---

⚖️ ইনজাংশনের প্রকারভেদ

বাংলাদেশের আইনে ইনজাংশন মূলত চার প্রকারে বিভক্ত:

---

🔸 ১. অন্তর্বর্তীকালীন ইনজাংশন (Temporary Injunction)

Order XXXIX, Rules 1–2, CPC অনুযায়ী আদালত কোনো পক্ষকে অস্থায়ীভাবে কোনো কাজ করা বা না করার নির্দেশ দিতে পারে। এটি মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কার্যকর থাকে।

ইনজাংশন দেওয়ার শর্ত:
আদালত তিনটি নীতি মেনে ইনজাংশন প্রদান করে—

1. Prima facie case: মামলাটি প্রথম দৃষ্টিতে সত্য বলে মনে হতে হবে।
2. Irreparable injury: ক্ষতি অর্থে পূরণ করা সম্ভব নয় এমন হতে হবে।
3. Balance of convenience: ইনজাংশন দিলে যে পক্ষ উপকৃত হবে, না দিলে তার ক্ষতি বেশি হবে।

📘 উদাহরণ:
যদি কোনো ব্যক্তি অন্যের জমিতে বেআইনিভাবে দখল নিতে চায়, আদালত তাকে “দখল পরিবর্তন না করার” নির্দেশ দিতে পারে।

---

🔸 ২. অ্যাড-ইন্টারিম ইনজাংশন (Ad-interim Injunction)

এটি জরুরি পরিস্থিতিতে দেওয়া ইনজাংশন। সাধারণত আদালত নোটিশ দেওয়ার আগেই, তাত্ক্ষণিক ক্ষতি ঠেকানোর জন্য এই আদেশ দেয়।
👉 এই আদেশ শুনানির আগ পর্যন্ত বা কিছুদিনের জন্য কার্যকর থাকে।

📘 উদাহরণ:
কোনো কোম্পানি প্রতিদ্বন্দ্বী ব্র্যান্ডের নাম নকল করে পণ্য বাজারে আনতে যাচ্ছে—তখন আদালত সঙ্গে সঙ্গে “বিক্রি বন্ধ রাখার” নির্দেশ দিতে পারে।

---

🔸 ৩. স্থায়ী ইনজাংশন (Permanent Injunction)

Specific Relief Act, Section 54 অনুসারে, আদালত কোনো অধিকার রক্ষার্থে মামলার চূড়ান্ত রায়ে এই ইনজাংশন প্রদান করে।
এটি মামলার নিষ্পত্তির পর কার্যকর হয় এবং স্থায়ীভাবে বলবৎ থাকে।

📘 উদাহরণ:
কোনো প্রকাশনা সংস্থাকে আদালত কপিরাইট লঙ্ঘন করে বই প্রকাশে স্থায়ীভাবে নিষেধ করে।

---

🔸 ৪. বাধ্যতামূলক ইনজাংশন (Mandatory Injunction)

Section 55, Specific Relief Act অনুযায়ী আদালত কোনো পক্ষকে নির্দিষ্ট কাজ করতে বাধ্য করতে পারে।
এটি একটি positive order, অর্থাৎ “কাজ করো” ধরনের আদেশ।

📘 উদাহরণ:
একজন মালিক প্রতিবেশীর জমিতে অবৈধ প্রাচীর তুলেছে—আদালত তাকে “প্রাচীর ভেঙে ফেলার” নির্দেশ দিতে পারে।

---

📚 হাইকোর্টের রুল ও নীতি

বাংলাদেশ হাইকোর্ট ইনজাংশন সম্পর্কিত বহু গুরুত্বপূর্ণ রায় প্রদান করেছে, যা এখন আদালতের নির্দেশনামূলক নীতি হিসেবে অনুসৃত হয়।

🔹 ১. Prima Facie Case

মামলাটি প্রথম দৃষ্টিতে বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। শুধু আশঙ্কা বা গুজবের ওপর ভিত্তি করে ইনজাংশন দেওয়া যায় না।

Case: Md. Abdul Latif vs. Bangladesh (52 DLR 345)
👉 আদালত বলেন, “ইনজাংশন অনুমাননির্ভর আশঙ্কার ভিত্তিতে নয়, বরং সুনির্দিষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে দিতে হবে।”

---

🔹 ২. Irreparable Injury

যে ক্ষতি একবার হলে অর্থের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব নয়, সেটিই “Irreparable Injury”।

Case: Abdul Gafur vs. Nurul Islam (44 DLR 321)
👉 আদালত বলেন, “ইনজাংশনের মূল উদ্দেশ্য হলো এমন ক্ষতি প্রতিরোধ করা, যা পুনরুদ্ধার অসম্ভব।”

---

🔹 ৩. Balance of Convenience

ইনজাংশন দিলে বা না দিলে কোন পক্ষের ক্ষতি বা সুবিধা বেশি হবে—আদালত সেটি বিবেচনা করে।

Case: Rahima Khatun vs. Abdul Mannan (45 DLR 321)
👉 আদালত বলেন, “যেখানে ইনজাংশন না দিলে আবেদনকারীর ক্ষতি হবে, অথচ দিলে প্রতিপক্ষ তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, সেখানে ইনজাংশন দেওয়া উচিত।”

---

🚫 ইনজাংশন বাতিলের কারণ

ইনজাংশন একটি অস্থায়ী প্রতিকার, এবং এটি আদালতের বিবেচনাধীন। নিম্নলিখিত কারণে আদালত ইনজাংশন বাতিল করতে পারে—

1. আবেদনকারী মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন করেছে।
2. প্রয়োজনীয় প্রমাণ বা Prima Facie Case অনুপস্থিত।
3. আবেদনকারীর উদ্দেশ্য দুরভিসন্ধিমূলক।
4. পরিস্থিতির মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে (Changed Circumstances)।
5. আবেদনকারী নিজেই আদালতের আদেশ লঙ্ঘন করেছে।

📘 Case Example: Mofizul Islam vs. Rokeya Begum (56 DLR 255) — আদালত বলেন, “যে পক্ষ Clean Hands নীতি লঙ্ঘন করবে, সে কোনো Equitable Relief পাওয়ার যোগ্য নয়।”

---

🏛️ ইনজাংশনের বাস্তব প্রয়োগ

বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইনজাংশনের ব্যবহার দেখা যায়—

🔹 সম্পত্তি বিরোধ

যখন কোনো পক্ষ জমি দখল পরিবর্তন করতে চায়, আদালত status quo বজায় রাখতে নির্দেশ দেয়।

📘 উদাহরণ: একটি জমি নিয়ে দুই ভাইয়ের বিরোধে আদালত “দখল পরিবর্তন না করার” নির্দেশ দেয়।

---

🔹 ব্যবসা ও বাণিজ্য

কোনো কোম্পানি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড বা ট্রেডমার্ক নকল করলে আদালত ইনজাংশন দিতে পারে।

📘 উদাহরণ: “বাংলা সফট ড্রিঙ্কস” নামের কোম্পানি “Coca Cola”-র প্যাকেজিং নকল করলে আদালত বিক্রি স্থগিত রাখতে আদেশ দেয়।

---

🔹 শিল্প ও কপিরাইট মামলা

কোনো লেখক, শিল্পী বা প্রযোজক তার কপিরাইট লঙ্ঘন প্রমাণ করতে পারলে আদালত স্থায়ী ইনজাংশন প্রদান করে।

📘 উদাহরণ: কোনো টেলিভিশন নাটক অনুমতি ছাড়া পুনঃপ্রচার করলে, প্রযোজক আদালতের মাধ্যমে তা বন্ধ করাতে পারেন।

---

🔹 পরিবেশ আইন

পরিবেশ আদালত প্রায়ই শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দূষণ কার্যক্রম বন্ধ রাখতে Mandatory Injunction প্রদান করে থাকে।

---

🔹 শ্রম আইন

শ্রমিক ছাঁটাই বা হঠাৎ লে-অফের ক্ষেত্রে শ্রম আদালত “status quo” বজায় রাখার নির্দেশ দিতে পারে, যাতে আলোচনা চলাকালীন শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত না হন।

---

🧩 ইনজাংশনের প্রভাব ও সীমাবদ্ধতা

ইনজাংশন আইনগতভাবে শক্তিশালী হলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে:

1. এটি আদালতের বিবেচনার ওপর নির্ভরশীল—অর্থাৎ সব আবেদনেই ইনজাংশন মেলে না।
2. এটি একটি Equitable Relief—তাই যার আচরণ অসৎ বা প্রতারণামূলক, সে ইনজাংশন পাবে না।
3. অনেক সময় প্রতিপক্ষের শুনানির আগে দেওয়া ex-parte injunction অপব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করে।
4. দীর্ঘস্থায়ী মামলায় অস্থায়ী ইনজাংশন বছরের পর বছর কার্যকর থেকে ন্যায়বিচার বিলম্বিত করে।

📘 High Court Observation:

“Temporary injunction should not be used as a permanent remedy; it is merely a shield, not a sword.”
— Bangladesh High Court Division, 2017

---

🔍 ইনজাংশনের প্রক্রিয়া (Step-by-Step)

1️⃣ আবেদন দাখিল:
দেওয়ানী আদালতে ইনজাংশন চেয়ে Order XXXIX Rule 1 or 2 CPC অনুযায়ী আবেদন করতে হয়।

2️⃣ অ্যাফিডেভিট সংযুক্ত:
আবেদনকারীর পক্ষ থেকে শপথনামা দিতে হয়, যেখানে ঘটনাবলী ও ক্ষতির সম্ভাবনা উল্লেখ থাকে।

3️⃣ শুনানি:
প্রথমে একতরফা (Ex-parte) শুনানিতে Ad-interim injunction দেওয়া যেতে পারে।

4️⃣ নোটিশ প্রদান:
পরবর্তীতে প্রতিপক্ষকে নোটিশ পাঠিয়ে উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত সিদ্ধান্ত নেন—ইনজাংশন স্থায়ী হবে কিনা।

5️⃣ বাতিলের আবেদন:
প্রতিপক্ষ চাইলে Order XXXIX Rule 4 CPC অনুযায়ী ইনজাংশন বাতিলের আবেদন করতে পারে।

---

📑 ইনজাংশনের অপব্যবহার

অনেক সময় দেখা যায়—

• প্রকৃত মালিক না হয়েও কেউ ইনজাংশনের আবেদন করে অন্যকে হয়রানি করছে।
• কাগজপত্র জাল করে আদালতকে বিভ্রান্ত করছে।
• অস্থায়ী ইনজাংশনের সুযোগ নিয়ে সম্পত্তি দখল করছে।

এগুলো প্রতিরোধে আদালত এখন cost বা penalty আরোপ করছে, যাতে আবেদনকারীরা দায়িত্বশীল থাকে।

📘 Case: Abdul Jalil vs. Kawsar Parvin (61 DLR 230) — আদালত বলেন, “মিথ্যা তথ্য দিয়ে ইনজাংশন নেওয়া আইনত শাস্তিযোগ্য অপব্যবহার।”

---

🧠 ন্যায়বিচারের দর্শন (Philosophical View)

ইনজাংশনের দর্শন মূলত Preventive Justice-এর ওপর ভিত্তি করে, যার উদ্দেশ্য:

“To maintain justice by preventing harm, rather than compensating after harm.”

বাংলাদেশের আইনি দর্শনে এটি একটি “মধ্যপন্থী প্রতিকার”—যেখানে আদালত উভয় পক্ষের ভারসাম্য বিবেচনা করে ন্যায্যতা রক্ষা করে।

---

🔚 উপসংহার

বাংলাদেশের দেওয়ানী আইন ব্যবস্থায় ইনজাংশন হলো ন্যায়বিচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা ক্ষতি প্রতিরোধে তাৎক্ষণিক সুরক্ষা প্রদান করে।

হাইকোর্টের স্থির মত হলো—

“Injunction is not a right; it is a relief granted only when justice demands.”

অতএব, ইনজাংশন প্রাপ্তির জন্য আবেদনকারীকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে—

1. তার বৈধ আইনি অধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কা আছে,
2. ক্ষতি অর্থে পূরণ করা সম্ভব নয়, এবং
3. ইনজাংশন না দিলে তার ক্ষতি প্রতিপক্ষের তুলনায় বেশি হবে।

ইনজাংশন আইনজীবী, ব্যবসায়ী, জমির মালিক ও সাধারণ নাগরিক—সবার জন্যই একটি কার্যকর আইনগত হাতিয়ার।
তবে এর ব্যবহার যেন অপব্যবহারে পরিণত না হয়, সে দিকেও আদালতের সদা সতর্ক দৃষ্টি থাকা প্রয়োজন।

---

✍️ লেখক: নাজমুল আলম অপু
আইনজীবী, আইনি গবেষক ও ব্লগার

---