🏛️ অগ্রক্রয় মামলা (Pre-emption Suit): কে, কখন, কীভাবে করতে পারে — বাংলাদেশি ও মুসলিম আইনের আলোকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ

---

---

🔹 ভূমিকা

বাংলাদেশে ভূমি ও সম্পত্তি সংক্রান্ত বিবাদের অন্যতম প্রচলিত ধরণ হলো “অগ্রক্রয় মামলা” বা Pre-emption suit।
এটি এমন একটি আইনি অধিকার, যেখানে কোনো জমি বিক্রি হলে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি—যেমন সহ-মালিক (co-sharer) বা সংলগ্ন মালিক (adjoining landholder)—ঐ জমিটি আদালতের মাধ্যমে নিজের নামে ক্রয় করার দাবি করতে পারেন, একই মূল্যে যেই দামে বিক্রি হয়েছে।

এর উদ্দেশ্য হলো জমির অখণ্ডতা রক্ষা, পারিবারিক সম্পত্তি একত্রে রাখা ও বাইরের লোকের প্রবেশ রোধ করা।

---

⚖️ কোন কোন আইনে অগ্রক্রয় মামলা করা যায়

বাংলাদেশে অগ্রক্রয়ের অধিকার (Right of Pre-emption) চারটি আইনের অধীনে স্বীকৃত —

ক্র.	প্রযোজ্য আইন	ধারা	প্রযোজ্য এলাকা/সম্পত্তি
১	State Acquisition and Tenancy Act, 1950	Section 96	কৃষি জমি (গ্রামীণ)
২	Non-Agricultural Tenancy Act, 1949	Section 24	শহর বা অ-কৃষি জমি
৩	Muslim Personal Law (Mohammadan Law)	Customary	মুসলমানদের মধ্যে ব্যক্তিগত অধিকার
৪	Partition Act, 1893	Section 4	যৌথ বসতবাড়ির সহ-মালিকানা

---

🧾 ১️⃣ State Acquisition and Tenancy Act, 1950 – Section 96

Section 96(1) অনুযায়ী—

কোনো জমির অংশ বিক্রি হলে, একই খতিয়ানের সহ-অংশীদার বা সংলগ্ন মালিক বিক্রয়ের ৪ মাসের মধ্যে অগ্রক্রয়ের মামলা করতে পারেন।

মূল বৈশিষ্ট্য:

• শুধুমাত্র কৃষি জমির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
• বিক্রিত জমির মূল্য আদালতে জমা দিতে হয়।
• মামলার আদালত: Assistant Judge, Civil Court।
• সময়সীমা: বিক্রয় জানার বা রেজিস্ট্রেশন জানার তারিখ থেকে ৪ মাস।

📘 রায়: Abdul Karim vs. Afsar Ali (44 DLR 67) — আদালত বলেন, Section 96 কেবল সহ-অংশীদার ও পার্শ্ববর্তী মালিকদের জন্য প্রযোজ্য।

---

🏙️ ২️⃣ Non-Agricultural Tenancy Act, 1949 – Section 24

Section 24 অনুযায়ী—

কোনো অ-কৃষি জমি বিক্রি হলে, যে কোনো সহ-মালিক বা সংলগ্ন জমির মালিক ৪ মাসের মধ্যে অগ্রক্রয়ের মামলা করতে পারেন।

বৈশিষ্ট্য:

• পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন বা শহরাঞ্চলের জমি।
• বিক্রয়মূল্য আদালতে জমা দিতে হয়।
• মামলার আদালত: Civil Judge (Assistant Judge)।

📘 রায়: Abdul Latif vs. Sufia Khatun (48 DLR 123) — “Non-agricultural জমির ক্ষেত্রে SAT Act নয়, NATA প্রযোজ্য।”

---

🕌 ৩️⃣ Muslim Personal Law (Mohammadan Law) অনুযায়ী অগ্রক্রয় (হক-এ-শুফা)

🔸 আইনি ভিত্তি

মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে অগ্রক্রয়ের অধিকারকে বলা হয় “হক-এ-শুফা (Haqq-e-Shufa)”।
এটি একটি Equitable right, যার উদ্দেশ্য হলো প্রতিবেশী বা সহ-মালিকদের অধিকার সংরক্ষণ এবং সমাজে সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়ে শৃঙ্খলা বজায় রাখা।

বাংলাদেশে এই অধিকার প্রযোজ্য হয়:

• যখন জমি মুসলিমদের মধ্যে বিক্রি হয়,
• এবং সেই জমি SAT Act বা NATA-এর আওতার বাইরে পড়ে (অর্থাৎ আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়)।

🔹 হক-এ-শুফার তিন ধরণ (Types of Shufa Rights):

1. Shafi-e-Sharik (সহ-মালিক):
   যৌথ মালিক যিনি একই জমিতে অংশীদার।
2. Shafi-e-Khalit (প্রতিবেশী):
   যার জমি বিক্রিত জমির সাথে সীমান্ত ভাগ করে।
3. Shafi-e-Jar (নিকটবর্তী মালিক):
   যিনি একই এলাকায় বা রাস্তার ওপারে নিকটবর্তী।

🔹 অগ্রাধিকারের ক্রম (Order of Preference):

1️⃣ সহ-মালিক
2️⃣ সীমান্ত-সংলগ্ন মালিক
3️⃣ নিকটবর্তী মালিক

📘 রায়: Abdur Rahman vs. Fazlur Rahman (13 DLR 177) —
“Mohammadan Law-এ Pre-emption অধিকার এখনও বিদ্যমান, যদি Statutory law দ্বারা প্রতিস্থাপিত না হয়।”

---

⚖️ মুসলিম আইনে মামলা করার শর্ত ও প্রক্রিয়া

🧾 (১) তিন ধাপের দাবি পদ্ধতি (Three Demands of Shufa)

মুসলিম আইনে মামলা করার আগে তিনটি “দাবি” (demands) পূরণ করতে হয়:

1. Talab-e-Mowasibat:
   বিক্রয় জানা মাত্রই তাত্ক্ষণিকভাবে মৌখিক দাবি করতে হবে — “আমি শুফার অধিকার প্রয়োগ করতে চাই।”
2. Talab-e-Ishhad:
   এরপর দুইজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে পুনরায় দাবি করতে হবে।
3. Talab-e-Da’wa:
   এরপর আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে।

এই তিনটি ধাপ প্রমাণ করতে না পারলে মামলা খারিজ হয়ে যায়।

📘 রায়: Abdul Jabbar vs. Mofiz Uddin (PLD 1960 Dacca 63) — তিনটি দাবি না করলে শুফার অধিকার কার্যকর নয়।

---

⚖️ মুসলিম আইনে অগ্রক্রয় মামলা করার প্রকিয়া (Step-by-Step)

ধাপ	বর্ণনা
১️⃣ বিক্রয়ের খবর পাওয়া	বিক্রয় রেজিস্ট্রি বা মৌখিকভাবে জানা মাত্র দাবি করতে হবে।
২️⃣ মৌখিক দাবি (Talab-e-Mowasibat)	“আমি শুফার অধিকার প্রয়োগ করতে চাই” — অবিলম্বে বলতে হবে।
৩️⃣ সাক্ষীর সামনে পুনরায় দাবি (Talab-e-Ishhad)	দুই সাক্ষীর উপস্থিতিতে পুনরায় দাবি।
৪️⃣ আদালতে মামলা দায়ের (Talab-e-Da’wa)	বিক্রয় জানার ৪ মাসের মধ্যে আদালতে মামলা।
৫️⃣ বিক্রয়মূল্য আদালতে জমা	বিক্রয় দলিলে উল্লেখিত মূল্য আদালতের ট্রেজারিতে জমা দিতে হয়।
৬️⃣ প্রমাণ ও শুনানি	তিন ধাপের দাবি ও শর্ত আদালতে প্রমাণ করতে হয়।
৭️⃣ রায় ও বাস্তবায়ন	আদালত প্রমাণ পেলে জমিটি প্রার্থীর নামে রেজিস্ট্রি করার নির্দেশ দেন।

---

💰 কোর্ট ফি (Court Fees) ও খরচ

অগ্রক্রয় মামলার কোর্ট ফি নির্ধারিত হয় বিক্রয়মূল্য অনুযায়ী।

বিক্রয়মূল্য	প্রযোজ্য কোর্ট ফি
৳ ১,০০,০০০ পর্যন্ত	২% (ন্যূনতম ৳৫০০)
৳ ১,০০,০০১ – ৳৫,০০,০০০	১.৫%
৳ ৫,০০,০০১ – ঊর্ধ্বে	১% (কিন্তু সর্বনিম্ন ৳১,০০০)

🔸 সাথে জমা দিতে হয়:

• বিক্রিত জমির মূল দাম (Treasury Challan মাধ্যমে)
• দলিলের ফটোকপি ও খতিয়ান
• দাখিলখারচ (court process fee)
• আইনজীবীর ফি (সাধারণত ৫,০০০–২০,০০০ টাকা পর্যন্ত, মামলার মান অনুযায়ী)

---

📚 প্রয়োজনীয় প্রমাণ ও দলিলপত্র

১️⃣ বিক্রয় দলিল (Deed of Sale)
২️⃣ দাগ ও খতিয়ান (CS, SA, RS, BS)
৩️⃣ মৌখিক দাবির সাক্ষী (Two witnesses)
৪️⃣ ভূমি রেকর্ড সার্টিফিকেট
৫️⃣ ট্যাক্স রশিদ (Union/City tax)
৬️⃣ কোর্ট ফি ও টাকা জমার চালান

---

🚫 মুসলিম আইনে অগ্রক্রয় মামলা খারিজের কারণ

• মৌখিক দাবি (Talab) প্রমাণ করতে ব্যর্থ হওয়া।
• বিক্রয় জানার ৪ মাস পর মামলা করা।
• আবেদনকারীর সহ-মালিক বা প্রতিবেশী না হওয়া।
• বিক্রয়ের আগে অধিকার প্রয়োগ না করা।

📘 রায়: Ali Ahmed vs. Hossain Mia (45 DLR 115) — “Late claim or defective Talab invalidates pre-emption right.”

---

⚖️ বাংলাদেশের আদালতের গুরুত্বপূর্ণ রায়

মামলা	উদ্ধৃতি	রায়ের মূল বক্তব্য
Abdul Karim vs. Afsar Ali	44 DLR 67	SAT Act কেবল সহ-মালিকদের জন্য প্রযোজ্য
Abdur Rahman vs. Fazlur Rahman	13 DLR 177	Muslim Law এখনও কার্যকর
Kali Charan vs. Surendra Nath	39 DLR 223	Dwelling house pre-emption valid under Partition Act
Abdul Jabbar vs. Mofiz Uddin	PLD 1960 Dacca 63	Talab-এর শর্ত না মানলে মামলা খারিজ হবে

---

🔚 উপসংহার

অগ্রক্রয় মামলা বাংলাদেশের ভূমি আইনে একটি শক্তিশালী কিন্তু সীমাবদ্ধ অধিকার।
এটি চারটি আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেও মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে হক-এ-শুফা (Haqq-e-Shufa) আজও প্রযোজ্য যেখানে কোনো Statutory আইন প্রযোজ্য নয়।

মামলা করার আগে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে:

• সঠিক আইন ও ধারা নির্ধারণ করা,
• বিক্রয় জানার ৪ মাসের মধ্যে মামলা করা,
• এবং আদালতে বিক্রয়মূল্য জমা দেওয়া।

✍️ লেখক:
নাজমুল আলম অপু
আইনজীবী ও আইনি ব্লগার

---