সড়ক পরিবহন আইন ও সড়ক নিরাপত্তা আইন ২০১৮: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

লেখক: অ্যাডভোকেট নাজমুল আলম অপু
📞 01715990741, 01680191991


বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা আজ একটি বড় জাতীয় সংকটে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে নিরীহ মানুষ—নষ্ট হচ্ছে পরিবারের স্বপ্ন ও সমাজের সম্পদ। এই ভয়াবহ বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সরকার “সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮” প্রণয়ন করে। এটি সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ, ট্রাফিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং সড়ক পরিবহন খাতে দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করার জন্য একটি যুগান্তকারী আইন।


🔸 আইন প্রণয়নের পটভূমি ও প্রয়োজনীয়তা

১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশ দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে পরিবহন খাতে প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটি আর কার্যকর থাকেনি। যানবাহনের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু চালক প্রশিক্ষণ, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এবং আইন প্রয়োগে ঘাটতি রয়ে গেছে।

২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের “নিরাপদ সড়ক আন্দোলন” দেশের জনগণকে নাড়া দেয়। এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নতুন আইন প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দেয়। অবশেষে ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদে “সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮” পাস হয় এবং ১ নভেম্বর ২০১৯ থেকে তা কার্যকর হয়।


🔸 আইনের উদ্দেশ্য

  • সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা
  • দুর্ঘটনা কমানো ও প্রাণহানি রোধ
  • ড্রাইভারদের প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স ব্যবস্থার সংস্কার
  • যাত্রীদের অধিকার সুরক্ষা
  • পরিবহন খাতকে আধুনিক ও জবাবদিহিমূলক করা

🔸 আইনের গুরুত্বপূর্ণ ধারা ও বিধান

১. ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানো

  • ধারা ৭৬: বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে ৬ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ২৫,০০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

২. বেপরোয়া চালনার কারণে মৃত্যু

  • ধারা ১০৫: অবহেলা বা বেপরোয়া চালনার ফলে মৃত্যু ঘটলে ৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান রয়েছে।
  • ইচ্ছাকৃত না হলে এটি খুনের মামলা (দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা) হিসেবে গণ্য হবে না।

৩. অতিরিক্ত গতি ও ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গ

  • ধারা ৮০: অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোয় ৩ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ১০,০০০ টাকা জরিমানা হতে পারে।
  • ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করলেও জরিমানা বা গাড়ি জব্দের ক্ষমতা রয়েছে।

৪. মাদকাসক্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো

  • ধারা ৮৪: মাদকাসক্ত অবস্থায় গাড়ি চালালে ৬ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান রয়েছে।

৫. যাত্রীদের অধিকার

  • নির্ধারিত ভাড়ার বেশি নেয়া বা অতিরিক্ত যাত্রী তোলা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
  • যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য সিসিটিভি ও GPS ব্যবস্থার নির্দেশনা রয়েছে।

৬. চালক ও মালিকদের দায়িত্ব

  • গাড়ির ফিটনেস, লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশন ও বীমা আপডেট রাখা বাধ্যতামূলক।
  • দুর্ঘটনা ঘটলে পালিয়ে গেলে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে।

🔸 আইন বাস্তবায়নের অগ্রগতি

২০২৩ ও ২০২৪ সালে সরকার সড়ক নিরাপত্তা জোরদার করতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে:

  • ডিজিটাল ড্রাইভিং লাইসেন্স ও স্মার্ট রেজিস্ট্রেশন চালু
  • ✅ প্রধান সড়কে সিসিটিভি মনিটরিং ও ট্রাফিক ক্যামেরা স্থাপন
  • রোড সেফটি টাস্কফোর্স গঠন ও নিয়মিত অভিযান
  • ✅ বাস ও ট্রাকের জন্য নির্দিষ্ট রুট ও স্টপেজ নির্ধারণ
  • ✅ চালকদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও কঠোর লাইসেন্স পরীক্ষার ব্যবস্থা
  • ✅ সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে “Zero Tolerance” নীতি চালু

🔸 বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ

যদিও আইনটি শক্তিশালী, কিন্তু কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের পথে রয়েছে কিছু প্রতিবন্ধকতা:

  • অদক্ষ ও অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত চালক
  • ট্রাফিক পুলিশের জনবল ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা
  • গণপরিবহন খাতে অরাজকতা ও দুর্নীতি
  • লাইসেন্স ও ফিটনেসে জালিয়াতি
  • জনগণের সচেতনতার অভাব

এই বাধাগুলো কাটিয়ে উঠতে হলে শুধু আইন থাকলেই হবে না, বরং কঠোর নজরদারি, প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি।


🔸 নাগরিকের ভূমিকা ও দায়িত্ব

একটি আইন কার্যকর করতে সরকারের পাশাপাশি নাগরিক সমাজকেও ভূমিকা রাখতে হবে। নাগরিকদের সচেতনতা ও দায়িত্বশীল আচরণ সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। যেমনঃ

  • বৈধ লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি না চালানো
  • ট্রাফিক সিগন্যাল মানা
  • হেলমেট ও সিটবেল্ট ব্যবহার করা
  • দুর্ঘটনা ঘটলে ভুক্তভোগীকে সাহায্য করা
  • অতিরিক্ত ভাড়া বা অনিয়ম দেখলে প্রতিবাদ করা

🔸 আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) রিপোর্ট অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্বে মৃত্যুর অন্যতম কারণ। বাংলাদেশ জাতিসংঘ ঘোষিত “Road Safety Decade of Action”–এর অংশ হিসেবে ২০২৩–২০৩০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। তাই বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক মানের পরিবহন আইন, সড়ক অবকাঠামো ও নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে তুলছে।


🔸 ভবিষ্যৎ করণীয়

  • আইন প্রয়োগে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।
  • আধুনিক ট্রাফিক প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়াতে হবে।
  • চালক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও লাইসেন্স পরীক্ষার মান উন্নত করতে হবে।
  • গণপরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।
  • শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

🔸 উপসংহার

“সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮” শুধু একটি আইন নয়—এটি একটি নিরাপদ বাংলাদেশ গঠনের দিকনির্দেশনা। আইনটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে দুর্ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। তবে এজন্য সরকারের পাশাপাশি পরিবহন মালিক, চালক, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সাধারণ নাগরিক—সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে।

সড়ক নিরাপত্তা একটি জাতীয় দায়িত্ব। প্রত্যেকে যদি আইন মেনে চলে ও অন্যকে সচেতন করে, তবে “নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ জীবন” বাস্তবে রূপ নেবে।


✍️ লেখক: অ্যাডভোকেট নাজমুল আলম অপু
📞 01715990741, 01680191991
📝 আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট (হাইকোর্ট বিভাগ)

📚 তথ্যসূত্র:

Leave a Reply