যৌতুক কি? কেউ যৌতুক চাইলে তার প্রতিকার কী?
যৌতুক: একটি সামাজিক অভিশাপ ও আইনগত প্রতিকার
✍️ লেখক: নাজমুল আলম অপু, এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
ভূমিকা
বাংলাদেশের পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামোয় ‘বিয়ে’ একটি পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক। কিন্তু বিয়েকে কেন্দ্র করে যে ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধিটি ভয়ংকর রূপ নিয়েছে তা হলো—যৌতুক। বিয়ের সময় বা পরে পাত্র বা তার পরিবারের পক্ষ থেকে অর্থ, সম্পত্তি বা মূল্যবান উপকরণের জন্য যে দাবি করা হয়, সেটাই যৌতুক।
যৌতুক আজ কেবল আর্থিক লেনদেনের বিষয় নয়, বরং এটি নারীর উপর নির্যাতন, শোষণ ও সহিংসতার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এই প্রথা রোধে সরকার “যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮” পাস করে, যা আইনগতভাবে যৌতুক চাওয়া, দেওয়া বা নেওয়াকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে।
যৌতুকের সংজ্ঞা: আইনগত ব্যাখ্যা
যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮-এর ২(খ) ধারায় যৌতুককে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে—
“যৌতুক অর্থ—কোনো ব্যক্তি বিবাহের প্রস্তাব দেওয়ার সময়, বিবাহের পূর্বে, বিবাহের সময়ে অথবা বিবাহের পরে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বর বা কনের পক্ষ হতে অথবা তাদের পক্ষাবলম্বনকারী অন্য কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের নিকট হইতে আদান-প্রদানকৃত অথবা আদান-প্রদান হইবার জন্য দাবিকৃত অর্থ, সম্পত্তি বা মূল্যবান কোন দ্রব্য।”
🔹 অর্থাৎ, বিয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত যে কোনো রকম আর্থিক দাবি বা সম্পত্তির দাবি—সে সরাসরি হোক বা পরোক্ষ, তা যৌতুক হিসেবে বিবেচিত হবে।
আইন অনুযায়ী যৌতুক সংক্রান্ত অপরাধ ও শাস্তি
✅ ধারা ৩: যৌতুক গ্রহণ বা দাবি করা
- যৌতুক দাবি বা গ্রহণ করলে:
- সর্বোচ্চ ৫ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড
- ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা
- অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া যেতে পারে।
✅ ধারা ৪: যৌতুকের জন্য নারীকে নির্যাতন
- যৌতুক না পেয়ে স্ত্রীকে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করলে:
- সর্বনিম্ন ১ বছর থেকে সর্বোচ্চ ৫ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড
- এবং অর্থদণ্ড।
✅ ধারা ৫: মিথ্যা মামলা দায়ের
- যদি কেউ প্রমাণিতভাবে মিথ্যা যৌতুক মামলা দায়ের করেন:
- সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড
- অথবা জরিমানা বা উভয় দণ্ড।
উচ্চ আদালতের রায় ও দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট যৌতুকবিরোধী আইনের প্রয়োগে বহুবার দিকনির্দেশনামূলক রায় দিয়েছেন।
✅ রেফারেন্স ১:
State vs. Md. Motaleb Hossain and Others, 69 DLR (HC) 2020, p. 491
➡️ হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণে বলেন:
“যৌতুক চাওয়া বা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দাবি করা—even if expressed as a family gift—is illegal and punishable under law.”
➡️ আদালত বলেন, ‘উপহার বা পারিবারিক অনুরোধ’ নামে যৌতুক চাপিয়ে দেওয়াও অপরাধ।
✅ রেফারেন্স ২:
State vs. Md. Sohel Rana, 72 DLR (HC) 2021, p. 233
➡️ এই মামলায় বলা হয়:
“মানসিক নির্যাতন, অনবরত চাপ সৃষ্টি, সামাজিক হুমকি ইত্যাদিও যৌতুক চাওয়ারই একটি অংশ, এবং তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।”
এই রায়ে আদালত যৌতুক বিষয়ক ‘মৌখিক চাপ ও প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়াও পরিস্থিতিগত প্রমাণ’ (circumstantial evidence)-কে বৈধ হিসেবে গণ্য করেছেন।
আইনগত প্রতিকার (Legal Remedies)
ভুক্তভোগী নারী ও তার পরিবার নিচের আইনগত প্রতিকার নিতে পারেন:
🔹 ১. ফৌজদারি মামলা (Criminal Case):
যৌতুক দাবি, গ্রহণ বা নির্যাতনের অভিযোগে আসামির বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ (FIR) দায়ের করা যায়। এছাড়া আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে সি. আর. (C.R) মামলাও দায়ের করা যায়।
🔹 ২. ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইন অনুসারে সাক্ষ্য:
পরিস্থিতিগত প্রমাণের ভিত্তিতেও আদালত দণ্ড দিতে পারে। অর্থাৎ, সরাসরি ভিডিও বা অডিও না থাকলেও পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী, চিকিৎসা প্রতিবেদন—এসবের ভিত্তিতে মামলা গ্রহণযোগ্য।
🔹 ৩. নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০২০:
যদি যৌতুকের কারণে মারধর, আগুনে পোড়ানো, হত্যা বা আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়া হয়, তবে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে এই আইনের অধীনে আরও কঠোর শাস্তি (যেমন মৃত্যুদণ্ড) হতে পারে।
🔹 ৪. পরিবার আদালতে দেনমোহর ও খোরপোষ মামলা:
যৌতুকের পাশাপাশি স্বামী যদি স্ত্রীকে ত্যাগ করে, তবে তিনি দেনমোহর, খোরপোষ ও পৃথক বসবাসের অধিকার আদায়ে মামলা করতে পারেন।
চ্যালেঞ্জ ও সুপারিশ
যৌতুক বিরোধী আইনের বাস্তবায়নে এখনো রয়েছে কিছু চ্যালেঞ্জ:
- সামাজিক লজ্জা ও হুমকির কারণে মামলা না করা
- পুলিশের অবহেলা
- সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহে জটিলতা
- বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘতা
সুপারিশ:
- সকল থানায় নারী সহায়তা ডেস্ক চালু ও সক্রিয় করা
- নারীদের আইনি সহায়তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
- সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও স্কুল-কলেজে শিক্ষামূলক কার্যক্রম
- নারী নেতৃত্বকে উৎসাহিত করা
উপসংহার
“যৌতুক” শুধুই একটি সামাজিক ব্যাধি নয়, এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ। “ভালো পরিবার”, “রেওয়াজ”, “উপহার” ইত্যাদি নাম দিয়ে যৌতুককে বৈধ করার চেষ্টাকে রুখে দিতে হবে। আইনকে কার্যকর করতে হলে, কেবল বিচার বিভাগ নয়—আমাদের প্রতিটি নাগরিককেই সচেতন ও সক্রিয় হতে হবে।
“বিয়ে হবে সম্মানের, লেনদেন নয়।”
এই নীতি প্রতিষ্ঠায় আইন প্রয়োগ, সামাজিক আন্দোলন এবং পারিবারিক শিক্ষা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
📌 লেখক পরিচিতি:
নাজমুল আলম অপু
এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
মোবাইলঃ ০১৬৮০১৯১৯৯১,৯১৭১৫৯৯০৭৪১।
E-mail: br.nazmul@gmail.com