ব্যাংক ঋণের জামিনদার হলে যে ভয়ংকর বিপদ আপনার অপেক্ষা করছে (বাংলাদেশ আইন ও আদালতের দৃষ্টিতে) 2025

সুপ্রিয় পাঠক, 

আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের অনুরোধে বা সামান্য সুবিধার লোভে অনেকেই ব্যাংক ঋণের জামিনদার (Guarantor) হয়ে যান। মনে করেন, “বড় একটা বিষয় না, শুধু কাগজে নাম সই করে দিলাম।” কিন্তু এই সহজ-সরল সইটিই আপনাকে নিয়ে যেতে পারে এক ভয়াবহ আর্থিক ও আইনি ঝামেলার দিকে! বাংলাদেশের আইন, বিশেষ করে অর্থ ঋণ আদালয় আইন, ২০০৩ (Artha Rin Adalat Ain 2003) এবং ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১, জামিনদারকে ঋণগ্রহীতার সমান দায়ে দায়ী করে রেখেছে। উচ্চ আদালতের রায়ও এই দায় এড়ানোর কোনো পথ রাখেনি।

জামিনদার মানে কী?

জামিনদার হলেন সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যিনি ঋণগ্রহীতার (Principal Borrower) পক্ষে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে দায় স্বীকার করেন। ঋণগ্রহীতা ঋণ শোধ না করলে বা চুক্তি লঙ্ঘন করলে, জামিনদারকেই আইনগতভাবে সেই দায় মেটাতে বাধ্য করা যায়।

 জামিনদার হলে আপনার কী কী বিপদ হতে পারে? (বাংলাদেশ আইন অনুযায়ী):

১. সম্পূর্ণ ঋণের দায় মেটানো (Primary Liability):

 অর্থ ঋণ আদালয় আইন, ২০০৩ এর ধারা ২৫: এই ধারা স্পষ্ট করে যে, ঋণ আদালত শুধু ঋণগ্রহীতাকেই নয়, জামিনদারকেও মামলার পক্ষ করতে পারবে এবং তার বিরুদ্ধেও ডিক্রি (Decree) দিতে পারবে। অর্থাৎ, ঋণগ্রহীতা দেউলিয়া হলেও বা পালালেও সম্পূর্ণ ঋণের টাকা (মূলধন + সুদ + জরিমানা + আইনি খরচ) আদায়ের দায়িত্ব পড়ে জামিনদারের উপর।

    উচ্চ আদালতের রায়: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ বারবারই রায় দিয়েছে যে জামিনদারিত্ব একটি স্বাধীন দায়বদ্ধতা (Independent Liability)। ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব না হলেও বা তার বিরুদ্ধে মামলা ব্যর্থ হলেও ব্যাংক সরাসরি জামিনদারের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে এবং তার সম্পত্তি বিক্রির আদেশ পেতে পারে। (উদাহরণ: হাইকোর্টের বিভিন্ন রিট পিটিশন ও আপিল মামলার রায়)।

২.  আপনার সম্পত্তি নিলামের ঝুঁকি (Attachment & Auction):

   অর্থ ঋণ আদালয় আইন, ২০০৩ এর ধারা ৩৩ ও ৩৪: এই আইনের অধীনে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি হয়। আদালত যদি ঋণ আদায়ের ডিক্রি দেয়, তবে ডিক্রি কার্যকর করার জন্য আদালত আপনার ব্যাংক একাউন্ট জব্দ (Garnishee Order) করতে পারে, আপনার বাড়ি, জমি, গাড়ি, ব্যবসায়িক স্থাপনা ক্রোক (Attachment) করতে পারে এবং সর্বোচ্চ নিলামে (Auction) বিক্রি করে ঋণের টাকা আদায়ের নির্দেশ দিতে পারে।

 বাস্তব উদাহরণ: কল্পনা করুন, আপনি আপনার ভাইয়ের ব্যবসায়িক ঋণের জামিনদার হয়েছিলেন। ব্যবসা লোকসান গেলে বা ভাই চলে গেলে ব্যাংক আপনার নামে অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করল। আদালত আপনার মূল বাসার বা সন্তানের পড়ালেখার জন্য রাখা জমিটিই নিলামে বিক্রির আদেশ দিতে পারে!

৩.  কৃষি জমি হারানোর ভয় (Agricultural Land Auction):

যদিও সাধারণত কৃষি জমি নিলামে বিক্রির ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ থাকে, তবে অর্থ ঋণ আদালত আইন, ২০০৩ একটি বিশেষ আইন। এই আইনের অধীনে আদালত ঋণ পরিশোধের জন্য জামিনদারের কৃষিজমিও নিলামের আদেশ দিতে পারে, বিশেষ করে যদি অন্য কোনও সম্পত্তি ঋণ পরিশোধের জন্য অপর্যাপ্ত হয়। এটা জামিনদারের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি।

৪.  ক্রেডিট রেটিং নষ্ট ও ভবিষ্যৎ ঋণে বাধা (Damaged CIB Report):

 ঋণ শোধে ব্যর্থতার কারণে আপনার নাম বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (CIB) রিপোর্টে খারাপ (Classified) হিসেবে চিহ্নিত হবে। এর ফলে ভবিষ্যতে আপনি নিজের জন্য ব্যাংক থেকে কোনও ঋণ (বাসা, গাড়ি, ব্যক্তিগত, শিক্ষা), এমনকি ক্রেডিট কার্ড পেতেও মারাত্মক বাধার সম্মুখীন হবেন। আপনার আর্থিক সুযোগ অনেকাংশে সীমিত হয়ে পড়বে।

৫.  পাসপোর্ট বাতিল ও বিদেশ যাওয়ার পথ বন্ধ (Travel Ban):

  অর্থ ঋণ আদালত ঋণ আদায় নিশ্চিত করতে জামিনদারের বিরুদ্ধে পাসপোর্ট বাতিল এবং বিদেশে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার (Travel Ban) আদেশ দিতে পারে। উচ্চ আদালতও সাধারণত এমন আদেশ বহাল রাখে। চাকরি, ব্যবসা বা চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার পরিকল্পনা থাকলে তা সম্পূর্ণ ভেস্তে যেতে পারে।

৬.  ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন ধ্বংস (Personal & Family Ruin):

 মামলা-মোকদ্দমার চাপ, আইনি খরচ, সমাজে মান-সম্মানহানি, সম্পত্তি হারানোর দুঃখ এবং ক্রমাগত আদালতের তলব সহ্য করা একজন মানুষের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। পারিবারিক সম্পর্কেও চরম টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়।

৭.  ঋণগ্রহীতার সাথে আপনার দ্বন্দ্ব (Conflict with Borrower):

 ঋণ পরিশোধের দায় আপনার উপর চাপলে স্বাভাবিকভাবেই আপনি ঋণগ্রহীতার উপর ক্ষুব্ধ হবেন এবং তার কাছ থেকে টাকা আদায়ের চেষ্টা করবেন। এর ফলে দীর্ঘদিনের আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সমাপ্তি ঘটতে পারে।

উচ্চ আদালত কি বলে?

বাংলাদেশের হাইকোর্ট বারবারই জামিনদারিত্বের কঠোর দায়বদ্ধতার দিকে ইঙ্গিত করে রায় দিয়েছে। আদালতের মৌলিক বক্তব্য হলো:

“জামিনদারিত্ব কোনও দয়া বা উপকারের বিষয় নয়; এটি একটি গুরুতর আইনি চুক্তি। জামিনদারকে অবশ্যই বুঝতে হবে যে, মূল ঋণগ্রহীতা ঋণ শোধ না করলে সম্পূর্ণ দায় তার উপরই বর্তাবে। ব্যাংক শুধু ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধেই নয়, জামিনদারের বিরুদ্ধেও পূর্ণ আইনি প্রতিকার প্রয়োগ করার অধিকারী।“

আপনি কি করতে পারেন? (কিছু সতর্কতা ও পরামর্শ):

১.  চিন্তা করে, জেনে-বুঝে জামিনদার হোন: কখনই শুধু আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের খাতিরে বা সামান্য লাভের লোভে জামিনদার হবেন না। এটা আপনার ভবিষ্যতের জন্য হুমকি।

২.  ঋণগ্রহীতার আর্থিক অবস্থা গভীরভাবে যাচাই করুন: তার আয়, ব্যবসার অবস্থা, পূর্বের ঋণ শোধের ইতিহাস, সম্পত্তির পরিমাণ ইত্যাদি ভালো করে খতিয়ে দেখুন। সে কি সত্যিই এই ঋণ শোধের সক্ষমতা রাখে?

৩. ঋণ চুক্তির শর্তাবলী (Terms & Conditions) মনোযোগ দিয়ে পড়ুন: আপনি ঠিক কী কী দায় স্বীকার করছেন, সুদের হার কত, ঋণের মেয়াদ কত, ডিফল্ট করলে কী হবে – প্রতিটি শব্দ বুঝে নিন। বিশেষ করে ‘Joint and Several Liability’ ক্লজ থাকলে তা মানে আপনি একাই পুরো ঋণের দায় নিচ্ছেন!

৪.  সীমিত দায়বদ্ধতার চেষ্টা করুন (যদি সম্ভব হয়): ব্যাংকের সাথে আলোচনা করে দেখুন কি না আপনি শুধু একটি নির্দিষ্ট অংকের (ঋণের অংশবিশেষ) বা নির্দিষ্ট সম্পত্তির (যেমন একটি বাড়ি) জন্য সীমিত দায়বদ্ধতা (Limited Liability) নিতে পারবেন কিনা। যদিও বাংলাদেশে সাধারণত ‘সম্পূর্ণ ও যৌথ দায়বদ্ধতা’ (Joint and Several Liability) চুক্তিই করা হয়।

৫.  লিখিত সমঝোতা (Side Agreement): ঋণগ্রহীতার সাথে একটি আলাদা লিখিত চুক্তি করুন, যাতে সে জামিনদার হিসেবে আপনার কোনও ক্ষতি হলে (যদি আপনাকে টাকা দিতে হয়) তা পূরণ করার অঙ্গীকার করে। অবশ্য এই চুক্তির আইনি কার্যকারিতা ঋণগ্রহীতার আর্থিক সক্ষমতার উপর নির্ভর করবে।

৬.  নিয়মিত নজর রাখুন: ঋণগ্রহীতা নিয়মিত কিস্তি শোধ করছে কিনা তা খেয়াল রাখুন। কোনও সমস্যা দেখা দিলেই সতর্ক হোন।

৭.  আইনজীবীর পরামর্শ নিন: জামিনদার হওয়ার আগে একজন অভিজ্ঞ ব্যাংকিং বা আর্থিক আইনজীবীর পরামর্শ নিন। তিনি আপনাকে ঝুঁকিগুলো ভালোভাবে বোঝাতে পারবেন এবং চুক্তির শর্তাবলী পরীক্ষা করে দিতে পারবেন।

সর্বোপরি মনে রাখবেন:

“ব্যাংক ঋণের জামিনদার হওয়া মানে শুধু সই করা নয়, আপনার ভবিষ্যৎ, আপনার পরিবারের নিরাপত্তা এবং আপনার কষ্টার্জিত সম্পদকে অন্যের ঋণের দায়ে বন্ধক রাখা!”

উপসংহার:

অনুরোধে পড়ে বা সামান্য লোভে পড়ে জামিনদার হওয়ার সিদ্ধান্ত আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলগুলোর একটি হতে পারে। বাংলাদেশের আইন (বিশেষ করে অর্থ ঋণ আদালয় আইন, ২০০৩) এবং আদালতের রায় জামিনদারকে রক্ষা করার জন্য নয়, বরং ব্যাংকের ঋণ আদায়ের পথ সুগম করার জন্য। তাই অত্যধিক সতর্কতা ও বিচক্ষণতা অবলম্বন করুন। জামিনদার হবার আগে অন্তত দশবার ভাবুন, সম্ভব হলে এড়িয়ে চলুন। আপনার আর্থিক সুরক্ষাই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।

বিঃদ্রঃ: এই ব্লগ পোস্টটি সাধারণ তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি। এটি কোনও আইনি পরামর্শ (Legal Advice) হিসাবে গণ্য হবে না। নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে আইনি সহায়তার জন্য একজন যোগ্য আইনজীবীর শরণাপন্ন হোন।

লেখক-

নাজমুল আলম অপু

এডভোকেট

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

মোবাইল-০১৬৮০১৯১৯৯১,০১৭১৫৯৯০৭৪১।

Leave a Reply