বাংলাদেশের মুসলিম পারিবারিক আইন, উচ্চ আদালতের রায় ও ব্যবহারিক নির্দেশিকা

বিচ্ছেদের পর সন্তান কার হবে

বাংলাদেশের মুসলিম পারিবারিক আইন, উচ্চ আদালতের রায় ও ব্যবহারিক নির্দেশিকা

বিবাহ বিচ্ছেদের পর সন্তানের হেফাজত (Custody) নিয়ে বাবা-মায়ের দ্বন্দ্ব সাধারণ ঘটনা। বাংলাদেশের আইন ও আদালত কী বলে? বিস্তারিত জেনে নিন:

 📜 হেফাজতের আইনি ভিত্তি 

মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ (ধারা ২৫)

– মায়ের অগ্রাধিকার: ছেলে সন্তানের ৭ বছর এবং মেয়ের বয়ঃসন্ধি পর্যন্ত মায়ের হেফাজতে থাকবে।

ব্যতিক্রম: 

  – মা অসচ্চরিত্র বা অক্ষম হলে 

  – সন্তানের কল্যাণের বিরোধী হলে (হাইকোর্ট রুল: শাহানা বেগম বনাম আব্দুর রহমান, ২০২০)

 বাবার অধিকার: 

– অভিভাবকত্ব (Guardianship): বাবা সন্তানের প্রকৃত অভিভাবক (ধারা ২৭) 

– ভরণপোষণ: বাবাকেই দিতে হবে (ধারা ৯)

 ⚖️ উচ্চ আদালতের ল্যান্ডমার্ক নির্দেশনা 

১. সন্তানের সর্বোত্তম স্বার্থ প্রধান বিবেচ্য (হাইকোর্ট: সালমা আক্তার বনাম জাকির হোসেন, ২০২২): 

   – শিশুর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানসিক বিকাশ 

   – বাবা/মায়ের আর্থিক সামর্থ্য ও নৈতিকতা 

২. মায়ের বিয়ের প্রভাব: 

   “মা পুনর্বিবাহ করলেই হেফাজত হারাবেন না” 

   (আপিল বিভাগ, রায় নং: ক্যাসি ৪৫/২০১৯)

৩. হেফাজত বনাম অভিভাবকত্ব: 

   – হেফাজত: দৈনন্দিন দেখভাল (মায়ের অধিকার) 

   – অভিভাবকত্ব: গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত (বাবার দায়িত্ব)

 📍 হেফাজত পরিবর্তনের শর্তাবলি 

| কারণ                  | উদাহরণ                     | আদালতের সিদ্ধান্ত         | 

|–|-|-| 

| মায়ের অসামর্থ্য   | মানসিক অসুস্থতা           | বাবাকে হেফাজত             | 

| শিশুর অনাগ্রহ     | ১২+ বছর বয়সী সন্তানের ইচ্ছা | তার পছন্দ বিবেচ্য         | 

| মায়ের অপসারণ     | বিদেশে চলে যাওয়া          | বাবা/নানীর হেফাজত        | 

 🔐 অভিভাবকত্বের বিশেষ ক্ষেত্র (ধারা ২৭) 

১. বাবা মারা গেলে: দাদা/ভাই 

২. আদালত সক্ষম ব্যক্তি নিয়োগ করতে পারে: 

   – চাচা, মামা, নানা 

   – (হাইকোর্ট রিট: ৭৮৯১/২০২১)

 ⚠️ বাবা-মায়ের সচরাচর ভুল 

❌ হেফাজত আটকানো: 

– শাস্তি: ৬ মাস কারাদণ্ড (গার্ডিয়ানস অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট, ১৮৯০) 

❌ সন্তান অপহরণ: 

– ফৌজদারি মামলা (ধারা ৩৬১, দণ্ডবিধি) 

 📂 হেফাজত চেয়ে মামলা করার প্রক্রিয়া 

ধাপ ১: পরিবার আদালতে আবেদন 

– প্রয়োজনীয় কাগজপত্র: 

  – বিবাহ বিচ্ছেদের দলিল 

  – সন্তানের জন্ম সনদ 

  – আয়ের প্রমাণ (ভরণপোষণের জন্য) 

ধাপ ২: সামাজিক অনুসন্ধান প্রতিবেদন 

– আদালত নিয়োগ করে প্রোবেশন অফিসার 

– বাসস্থান, আর্থিক অবস্থা, পারিপার্শ্বিকতা যাচাই 

# ধাপ ৩: অন্তর্বর্তী আদেশ 

– ৩০ দিনের মধ্যে ভিজিটেশন রাইটস নির্ধারণ 

 🛡️ সন্তানের অধিকার সুরক্ষা 

১. শিক্ষা অধিকার: 

   – বাবাকে বাধ্যতামূলক শিক্ষা খরচ দিতে হবে 

   – (হাইকোর্ট: রিট ৫৬৭৮/২০২২) 

২. ভরণপোষণ: 

   – ছেলে: ১৮ বছর পর্যন্ত 

   – মেয়ে: বিয়ে পর্যন্ত 

৩. সাক্ষাৎকারের অধিকার: 

   – অপর পক্ষ সপ্তাহে ১-২ বার দেখা নিশ্চিত করবে 

 📞 জরুরি আইনি সহায়তা 

– জাতীয় আইনি সহায়তা সংস্থা (NALSA): ১৬১২৩ 

– মহিলা ও শিশু বিষয়ক হেল্পলাইন: ১০৯ 

– বিনামূল্যা আইনজীবী: জেলা আইনজীবী সমিতি 

 💡 উপসংহার: আপনার করণীয়

১. পরিবার আদালতে আবেদন দিন হেফাজত/ভিজিটেশন রাইটসের জন্য 

২. সন্তানের ইচ্ছা আদালতে জানান (যদি ১২+ বছর বয়সী হয়) 

৩. ভরণপোষণ ডিক্রি নিন সমান্তরালভাবে 

⚖️ সতর্কীকরণ: 

– সন্তানকে জোর করে আটকালে হেবিয়াস কর্পাস রিট করুন হাইকোর্টে 

– মিথ্যা মামলায় জেল-জরিমানা হতে পারে 

আইনি নোট: এই তথ্য মুসলিম পারিবারিক আইন, গার্ডিয়ানস অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট ১৮৯০, এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ২০২৪ সাল পর্যন্ত রায়ভিত্তিক। ব্যক্তিগত পরামর্শের জন্য আইনজীবী নিন।

লেখক-

নাজমুল আলম অপু

এডভোকেট

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ।

মোবাইলঃ ০১৬৮০১৯১৯৯১,০১৭১৫৯৯০৭৪১।

Leave a Reply