বাংলাদেশে মিথ্যা মামলা: প্রতিকার, শাস্তি ও ক্ষতিপূরণের আইনি পথনির্দেশিকা

✍️ নাজমুল আলম অপু, আইনজীবী ও আইনি ব্লগার


ভূমিকা

বাংলাদেশে মিথ্যা মামলা একটি বহুল প্রচলিত সমস্যা, যা ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ—সব ক্ষেত্রেই ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। প্রতিশোধ, হয়রানি, আর্থিক সুবিধা বা ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে অনেকেই নির্দোষ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে থাকেন। এর ফলে ভুক্তভোগীকে শুধু আদালতের দৌড়ঝাঁপ নয়, বরং মানসিক ও সামাজিক যন্ত্রণাও সহ্য করতে হয়। তবে বাংলাদেশের আইনে মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে স্পষ্ট প্রতিকার, শাস্তি এবং ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রয়েছে—যা জানা অত্যন্ত প্রয়োজন।


Crime and offenses in country Concept

১. মিথ্যা মামলা চিহ্নিত করার উপায়

মিথ্যা মামলা সাধারণত কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে বোঝা যায়—

  • অপ্রমাণিত অভিযোগ: যেসব অভিযোগের সাথে বাস্তব ঘটনা বা প্রমাণের মিল নেই।
  • দূরভিসন্ধিমূলক উদ্দেশ্য: প্রতিশোধ নেওয়া বা হয়রানি করার অভিপ্রায় থাকে।
  • জাল দলিল বা সাক্ষী: কৃত্রিম দলিল সংযুক্ত করা বা মিথ্যা সাক্ষীর নাম দেওয়া।
  • ঘটনাকালীন অসঙ্গতি: সময়, স্থান বা ঘটনার বর্ণনায় স্পষ্ট পার্থক্য থাকে।

এই লক্ষণগুলো দেখলে আইনজীবীর সঙ্গে দ্রুত পরামর্শ নেওয়া উচিত।


২. তাৎক্ষণিক করণীয় পদক্ষেপ

ক. আইনি পরামর্শ গ্রহণ

যে মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন, তার প্রকৃতি বুঝে উপযুক্ত আইনজীবীর পরামর্শ নিন।

  • ফৌজদারি মামলা হলে ক্রিমিনাল লইয়ার
  • দেওয়ানি মামলা হলে সিভিল লইয়ার

প্রথমেই জামিন ও মামলার কপি সংগ্রহ করতে হবে।

খ. প্রমাণ সংগ্রহ

  • ঘটনার সময় আপনি অন্যত্র ছিলেন তা প্রমাণে অ্যালিবাই তৈরি করুন।
  • সিসি ক্যামেরা ফুটেজ, মোবাইল কল রেকর্ড, ব্যাংক স্টেটমেন্ট ইত্যাদি সংগ্রহ করুন।
  • স্বাধীন সাক্ষীদের যোগাযোগ সংরক্ষণ করুন।

৩. আইনি প্রতিকার ও শাস্তি

ক. ফৌজদারি প্রতিকার (Penal Code, 1860)

বাংলাদেশ দণ্ডবিধিতে মিথ্যা মামলার জন্য কঠোর শাস্তি নির্ধারিত আছে:

ধারাঅপরাধশাস্তি
ধারা ১৮২পুলিশকে মিথ্যা তথ্য প্রদানসর্বোচ্চ ৩ মাস কারাদণ্ড
ধারা ১৯১মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানসর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ড
ধারা ২০৯মিথ্যা মামলা দায়েরসর্বোচ্চ ২ বছর কারাদণ্ড ও জরিমানা

ফৌজদারি কার্যবিধি (CrPC), ধারা ২৫০ অনুযায়ী আদালত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ দিতে পারেন—সর্বোচ্চ ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত।


খ. দেওয়ানি প্রতিকার (Specific Relief Act, 1877)

যদি মিথ্যা মামলার কারণে আর্থিক ক্ষতি বা মানহানি হয়, তাহলে ক্ষতিপূরণ মামলা (Compensation Suit) করা যায়।

  • ধারা ২০: মানহানির ক্ষতিপূরণ দাবি
  • ধারা ২২: মিথ্যা অভিযোগের কারণে আর্থিক ক্ষতির প্রতিকার

এই মামলা সাধারণত দেওয়ানি আদালতে দায়ের করা হয়।


গ. সাংবিধানিক প্রতিকার

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩১ ও ৩৫ নাগরিকের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত করে।
যদি মিথ্যা মামলার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বেআইনিভাবে হয়রানির শিকার হন, তবে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা সম্ভব।


৪. গুরুত্বপূর্ণ আদালতের রায়

  1. রাষ্ট্র বনাম আব্দুল মান্নান (২০১৯)
    আদালত রায় দেয়—মিথ্যা মামলা দায়েরকারীকে কঠোর কারাদণ্ড দেওয়া হবে, কারণ এটি বিচার ব্যবস্থার অপব্যবহার।
  2. সালমা বেগম বনাম বাংলাদেশ (২০২০)
    মানহানিকর মিথ্যা মামলার অভিযোগ প্রমাণিত হলে আদালত ভুক্তভোগীকে ৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়।

৫. মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে বিশেষ আইনসমূহ

  • ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ (ধারা ২৯): অনলাইনে মিথ্যা তথ্য প্রচার বা হয়রানির শাস্তি ৩ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড।
  • নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ধারা ১৪: ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা মামলা দায়ের করলে অভিযুক্তের শাস্তি হতে পারে।

৬. ক্ষতিপূরণ আদায়ের প্রক্রিয়া

১️⃣ ফৌজদারি আদালতে আবেদন:
CrPC ধারা ২৫০ অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের আবেদন করা যায়।

২️⃣ দেওয়ানি মামলা:
মিথ্যা মামলার ফলে হওয়া মানসিক যন্ত্রণা, আর্থিক ক্ষতি বা ব্যবসায়িক ক্ষতির জন্য আলাদা ক্ষতিপূরণ মামলা করা যায়।

৩️⃣ রিট মামলা (High Court):
মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে Article 102 অনুযায়ী রিট আবেদন করা সম্ভব।


৭. প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা

  • প্রাথমিক তদন্তে সচেতনতা: অভিযোগ দায়েরের আগে পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ জানানো যেতে পারে।
  • সামাজিক ও গণমাধ্যম সচেতনতা: সত্য তথ্য প্রকাশে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখা।
  • আইনি শিক্ষার প্রসার: সাধারণ মানুষকে সচেতন করা যাতে তারা প্রতিশোধের উদ্দেশ্যে মিথ্যা মামলা না করে।

৮. ব্যক্তিগত পরামর্শ

১️⃣ আতঙ্কিত না হয়ে আইনজীবীর নির্দেশনা মেনে চলুন।
২️⃣ আদালতের সমন পেলে পালিয়ে না গিয়ে উপস্থিত থাকুন।
৩️⃣ মামলার প্রতিটি কপি ও কাগজপত্র সংরক্ষণ করুন।
৪️⃣ প্রমাণ ধ্বংস না করে আইনগতভাবে ব্যবহার করুন।


উপসংহার

মিথ্যা মামলা সমাজে একটি অন্যায় সংস্কৃতি হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। তবে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও সচেতন নাগরিক ভূমিকার মাধ্যমে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। মনে রাখবেন, বাংলাদেশের আইন নির্দোষ ব্যক্তির সুরক্ষায় যথেষ্ট শক্তিশালী—প্রয়োজন শুধু সময়মতো সঠিক আইনি পদক্ষেপ নেওয়া।
আইন কখনোই অন্যায়ের হাতিয়ার নয়; বরং ন্যায়ের রক্ষাকবচ।


তথ্যসূত্র

  1. দণ্ডবিধি, ১৮৬০
  2. ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮
  3. নির্দিষ্ট প্রতিকার আইন, ১৮৭৭
  4. বাংলাদেশ সংবিধান
  5. বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের রায়সমূহ

Leave a Reply