বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কি সংবিধান পরিবর্তন করতে পারে? — সাংবিধানিক ও আইনি বিশ্লেষণ
ভূমিকা
বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বোচ্চ দলিল হলো সংবিধান। সংবিধানই রাষ্ট্রের কাঠামো, শাসনব্যবস্থা ও নাগরিকদের অধিকার নির্ধারণ করে। এই সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা অত্যন্ত সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, কারণ এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি প্রভাবিত হতে পারে। বিশেষ করে যখন একটি নির্বাচিত সংসদ নয়, বরং একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকে—তখন এই প্রশ্নটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কি সংবিধান পরিবর্তন করতে পারে? এই লেখায় বাংলাদেশের সংবিধান, সুপ্রিম কোর্টের রায়, রাজনৈতিক ইতিহাস এবং আইনি দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হবে।

সংবিধান সংশোধনের সাংবিধানিক প্রক্রিয়া
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সংবিধান সংশোধনের জন্য একটি স্পষ্ট এবং কঠোর প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা হয়েছে। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে:
- সংসদে প্রস্তাব উত্থাপন:
সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব কেবল সংসদের একজন সদস্য উত্থাপন করতে পারেন। অর্থাৎ, জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। - দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা:
সংসদে উপস্থিত সদস্যদের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন পেলে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। এটি নিশ্চিত করে যে কোনো সংশোধনই জনগণের বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব ছাড়া সম্ভব নয়। - রাষ্ট্রপতির অনুমোদন:
সংসদে প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের মাধ্যমে সংশোধনীটি কার্যকর হয়।
এছাড়াও বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী, সংবিধানের মৌলিক কাঠামো (Basic Structure) পরিবর্তন করা যায় না। যেমন—গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, নাগরিক অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ইত্যাদি মৌলিক নীতি অক্ষুণ্ন রাখতে হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাংবিধানিক অবস্থান
বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটি এসেছে ১৯৯৬ সালের ১৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে। এর আগে নির্বাচনকালীন সময়ে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে আস্থা সংকট দেখা দিলে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে এই ব্যবস্থা চালু হয়।
তবে ২০১১ সালে ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী:
- প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রিসভার অধীনে নির্বাচনকালীন সরকার কাজ করে (আর্টিকেল ৫৮(৩))।
- কোনো পৃথক “অন্তর্বর্তী সরকার” বা “তত্ত্বাবধায়ক সরকার” এর সাংবিধানিক ভিত্তি বর্তমানে নেই।
- বিশেষ পরিস্থিতিতে যদি অন্তর্বর্তী বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়, তার ক্ষমতা আইনগতভাবে সীমিত থাকবে।
তাদের মূল ভূমিকা হলো:
- নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা,
- রাষ্ট্রের দৈনন্দিন প্রশাসনিক কাজকর্ম চালানো,
- কোনো বিতর্কিত বা দীর্ঘমেয়াদি নীতি নির্ধারণ না করা।
অর্থাৎ, একটি অন্তর্বর্তী সরকার কেবল অস্থায়ী প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করে; তারা কোনো স্থায়ী বা নীতিগত পরিবর্তন আনার সাংবিধানিক ক্ষমতা রাখে না।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কি সংবিধান সংশোধন করতে পারে?
১. সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা
সংবিধান স্পষ্টভাবে বলেছে যে, সংবিধান সংশোধনের একমাত্র বৈধ উপায় হলো সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে প্রস্তাব পাস করা (আর্টিকেল ১৪২)। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় বা স্থগিত থাকে। ফলে সংসদের মাধ্যমে কোনো প্রস্তাব উত্থাপন বা অনুমোদন সম্ভব নয়। সুতরাং, এই অবস্থায় সংবিধান পরিবর্তনের কোনো সাংবিধানিক পথ নেই।
২. সুপ্রিম কোর্টের রায় ও আইনি দৃষ্টিভঙ্গি
- খন্দকার দেলোয়ার হোসেন বনাম বাংলাদেশ (২০১১) মামলায় সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট করে বলেছে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা অস্থায়ী এবং সীমিত। তারা কেবল নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে—সংবিধান পরিবর্তনের ক্ষমতা নেই।
- আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ (১৯৮৯) মামলায় আদালত বলেছে, সংবিধানের মৌলিক কাঠামো কোনো অবস্থাতেই পরিবর্তন করা যাবে না।
- আদালত আরও বলেছে, কোনো অনির্বাচিত সরকার বা অস্থায়ী সরকার যদি সংবিধান পরিবর্তনের চেষ্টা করে, সেটি অবৈধ ঘোষণা করা হবে।
৩. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
- ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুধু নির্বাচন পরিচালনা করেছে। সংবিধান সংশোধনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
- ২০০৭-২০০৮ সালের ফখরুদ্দীন আহমেদ নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘ দুই বছর ক্ষমতায় থাকলেও সংবিধান পরিবর্তন করেনি; বরং তারা নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংসদ গঠনের পথ তৈরি করেছিল।
- পরবর্তীতে নির্বাচিত সরকারই সংবিধান সংশোধন করেছে—অন্তর্বর্তী সরকার নয়।
যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংবিধান পরিবর্তনের চেষ্টা করে, তবে কী হবে?
- আইনগত বাধা:
সংবিধানের ৭(খ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে—জনগণের ভোটের বাইরে কোনো সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার বৈধতা অর্জন করতে পারবে না। সুতরাং, অন্তর্বর্তী সরকার যদি সংবিধান সংশোধনের চেষ্টা করে, তা হবে অসাংবিধানিক ও বেআইনি। - সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ:
আদালত এই ধরনের উদ্যোগের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ (Stay Order) দিতে পারে। ২০০৭ সালের জরুরি অবস্থা মামলায় আদালত এমন নজির সৃষ্টি করেছে। - আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া:
জাতিসংঘ (UN), ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU), ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এমন উদ্যোগকে অগণতান্ত্রিক বলে নিন্দা জানাতে পারে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও কূটনৈতিক সম্পর্কেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। - রাজনৈতিক সংকট:
সংবিধান পরিবর্তনের বেআইনি প্রচেষ্টা জনগণের আস্থা হারাবে এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করবে। এটি নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতাকেও ক্ষুণ্ণ করবে।
জনগণের অধিকার ও ভূমিকা
সংবিধান বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমতার উৎস হিসেবে নির্ধারিত। সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ, এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করিবে কেবল সংবিধানানুযায়ী গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহ।”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংবিধান সংশোধন করার ক্ষমতা না থাকলেও, জনগণ চাইলে:
- নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংসদ গঠন করে সংবিধান পরিবর্তনের উদ্যোগ নিতে পারে,
- রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে সংশোধনী প্রস্তাব সমর্থন করতে পারে,
- আদালতের মাধ্যমে কোনো বেআইনি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে রিট আবেদন করতে পারে।
উপসংহার
বাংলাদেশের সংবিধান জনগণের দ্বারা প্রণীত ও সংসদের মাধ্যমে সংশোধনযোগ্য একটি সর্বোচ্চ আইন। অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি অস্থায়ী প্রশাসনিক কাঠামো, যার মূল কাজ হলো একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা। তাদের কোনো সাংবিধানিক বা আইনি অধিকার নেই সংবিধান পরিবর্তনের।
সুপ্রিম কোর্টের রায়, সংবিধানের ধারা এবং অতীতের অভিজ্ঞতা—সবই স্পষ্ট করে যে সংবিধান সংশোধনের একমাত্র বৈধ উপায় নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে। অন্তর্বর্তী সরকারের এমন কোনো পদক্ষেপ শুধু অসাংবিধানিকই নয়, বরং রাষ্ট্রে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
সুতরাং, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি কখনও সংবিধান পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়, তবে তা আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ হবে এবং আদালতের মাধ্যমে বাতিল হবে। গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং জনগণের সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা নির্বাচিত সংসদের হাতেই থাকা উচিত।
✍️ লেখক: অ্যাডভোকেট নাজমুল আলম অপু
📞 Cell: 01715990741, 01680191991
📚 তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ সংবিধান ১৯৭২ (সংশোধিত), আনোয়ার হোসেন মামলা (১৯৮৯), খন্দকার দেলোয়ার হোসেন মামলা (২০১১), ১৩তম ও ১৫তম সংশোধনী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের রায়সমূহ।