বাংলাদেশে পুলিশের গ্রেফতার ও জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষমতা: আইন, আদালতের ব্যাখ্যা ও নাগরিক অধিকার
সারসংক্ষেপ (Abstract)
পুলিশ প্রশাসন রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার অন্যতম অঙ্গ। তবে পুলিশের গ্রেফতার ও জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষমতা নাগরিক স্বাধীনতার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত হওয়ায় এর অপব্যবহার আইনের শাসনের জন্য গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮, দণ্ডবিধি, ১৮৬০ ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-তে পুলিশের এই ক্ষমতা নির্ধারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি উচ্চ আদালত বিভিন্ন মামলায় এই ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ করেছে। এই প্রবন্ধে আইনগত কাঠামো, বিচারিক ব্যাখ্যা এবং নাগরিক প্রতিকার বিশ্লেষণের মাধ্যমে পুলিশের গ্রেফতার ও জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষমতার ভারসাম্য নির্ণয় করা হয়েছে।
১. ভূমিকা (Introduction)
রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের ভূমিকা অপরিহার্য। অপরাধ প্রতিরোধ ও তদন্তের জন্য কিছু বিশেষ ক্ষমতা তাদের প্রয়োজন। কিন্তু সেই ক্ষমতা সীমাহীন নয়। পুলিশের বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার বা জিজ্ঞাসাবাদের নামে কাউকে আটক করা—এই দুটি ক্ষেত্রেই নাগরিক অধিকার ও আইনের শাসনের প্রশ্ন জড়িত।
বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২ ও ৩৩ ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের অধিকার নিশ্চিত করে। সুতরাং, পুলিশের প্রতিটি পদক্ষেপ সংবিধান ও আইনের সীমার মধ্যে থাকতে বাধ্য। এই প্রবন্ধে সেই সীমারেখা বিশ্লেষণ করা হয়েছে আইন, রায় ও বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে।

২. পুলিশের গ্রেফতারের ক্ষমতা: আইনগত ভিত্তি
২.১ ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ধারা ৫৪
বাংলাদেশে পুলিশের বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতারের ক্ষমতা প্রধানত ধারা ৫৪-এর মাধ্যমে নির্ধারিত।
এই ধারা অনুযায়ী, পুলিশ নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করতে পারে—
- যখন কোনো ব্যক্তি ফৌজদারি অপরাধে জড়িত বলে যৌক্তিক সন্দেহ থাকে;
- যখন তার কাছ থেকে অবৈধ অস্ত্র, মাদক বা চুরি করা মালামাল উদ্ধার হয়;
- যখন সে প্রমাণ নষ্ট বা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে;
- যখন জনশৃঙ্খলা ভঙ্গ বা দাঙ্গা সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে।
তবে এই ক্ষমতা শর্তসাপেক্ষ, অর্থাৎ পুলিশকে প্রতিটি গ্রেফতারের জন্য যথাযথ কারণ লিখিতভাবে উল্লেখ করতে হয়।
২.২ ঐতিহাসিক রায়: BLAST বনাম বাংলাদেশ (২০০৩)
২০০৩ সালে Bangladesh Legal Aid and Services Trust (BLAST) বনাম বাংলাদেশ মামলায় (৫৫ DLR (HCD) ৩৬৩) হাইকোর্ট ধারা ৫৪-এর সীমা নির্ধারণ করে এক যুগান্তকারী রায় প্রদান করেন। আদালত বলেন:
“পুলিশ বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতারের আগে অবশ্যই সন্দেহের যৌক্তিক কারণ লিখিতভাবে উল্লেখ করবে, অন্যথায় গ্রেফতার বেআইনি।”
এই রায়ের মাধ্যমে আদালত ১৫টি দিকনির্দেশনা প্রদান করেন, যার মধ্যে অন্যতম ছিল—
- গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা বাধ্যতামূলক;
- পরিবারের সদস্যদের দ্রুত জানানো;
- পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন বা জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি নিষিদ্ধ।
২.৩ ধারা ৫৫ ও অন্যান্য ধারা
ধারা ৫৫ অনুসারে, কোনো সাব-ইন্সপেক্টর বা তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যদি মনে করেন যে কোনো ব্যক্তি জামিন অযোগ্য অপরাধে জড়িত, তবে তিনি বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করতে পারেন।
তবে ধারা ৬৪ অনুযায়ী, গ্রেফতারকারী পুলিশ কর্মকর্তাকে অবশ্যই গ্রেফতারের কারণ জানাতে হবে।
৩. জিজ্ঞাসাবাদের আইনগত কাঠামো
৩.১ সাধারণ জিজ্ঞাসাবাদ বনাম আটক
পুলিশ কাউকে সাধারণ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় ডাকতে পারে (ধারা ১৬০, CrPC), কিন্তু জোরপূর্বক আটক রাখতে পারে না।
কাউকে থানায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা তখনই বৈধ যখন—
- তিনি অভিযুক্ত বা সন্দেহভাজন;
- এবং তাকে বৈধভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে।
৩.২ ২৪ ঘণ্টার নিয়ম ও রিমান্ড
ধারা ৬১ (CrPC) অনুযায়ী, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রেরণ করতে হবে।
এর পর ধারা ১৬৭ অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট চাইলে রিমান্ড মঞ্জুর করতে পারেন, তবে:
- রিমান্ড সর্বোচ্চ ৫ দিন, বিশেষ ক্ষেত্রে ১৫ দিন পর্যন্ত হতে পারে;
- ম্যাজিস্ট্রেটকে অবশ্যই দেখতে হবে যে রিমান্ড তদন্তের স্বার্থে অপরিহার্য কি না;
- রিমান্ডের সময় আইনজীবীর উপস্থিতির সুযোগ দিতে হবে।
৩.৩ আদালতের ব্যাখ্যা
- আসাদুজ্জামান বনাম রাষ্ট্র (২০১৮): আদালত বলেন, “জোরপূর্বক বা নির্যাতনের মাধ্যমে নেওয়া স্বীকারোক্তি অগ্রহণযোগ্য।”
- রুবেল বনাম বাংলাদেশ (২০২০): হাইকোর্ট রায় দেন যে, “জিজ্ঞাসাবাদের নামে কাউকে দীর্ঘ সময় আটক রাখা অবৈধ ও সংবিধানবিরোধী।”
৪. নাগরিক অধিকার ও আইনি প্রতিকার
৪.১ সংবিধানগত সুরক্ষা
- অনুচ্ছেদ ৩২: “কোনো ব্যক্তিকে আইনের আশ্রয় ব্যতিরেকে জীবন বা ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।”
- অনুচ্ছেদ ৩৩: গ্রেফতারের পর ব্যক্তিকে কারণ জানানো ও আইনজীবীর সহায়তা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করে।
৪.২ অবৈধ গ্রেফতারের বিরুদ্ধে করণীয়
- জামিন আবেদন: নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আবেদন করা যায়।
- হেবিয়াস কর্পাস (Habeas Corpus): হাইকোর্টে রিট দায়ের করে অবৈধ আটক থেকে মুক্তির দাবি করা যায়।
- পুলিশ সুপার বা কমিশনারের কাছে অভিযোগ: প্রশাসনিক তদন্ত শুরু হতে পারে।
- জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (NHRCB)-এ অভিযোগ দায়ের করা যায়।
৪.৩ ক্ষতিপূরণের অধিকার
ফৌজদারি কার্যবিধি ধারা ২৯৬ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি অবৈধ গ্রেফতারের শিকার হন, তিনি আদালতের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারেন।
এছাড়া BLAST বনাম বাংলাদেশ (২০০৩) মামলায় আদালত ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশও দিয়েছিলেন।
৫. বিশেষ পরিস্থিতিতে গ্রেফতার
৫.১ নারী ও শিশুদের গ্রেফতার
- ধারা ৪৬(৪), CrPC: কোনো নারীকে মহিলা পুলিশ অফিসার ছাড়া গ্রেফতার করা যাবে না।
- শিশু আইন, ২০১৩ ও জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট, ২০১৮: ১৮ বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে বিশেষ সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রযোজ্য।
৫.২ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮
- ধারা ৪৩: ডিজিটাল বা অনলাইন অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করতে পারে, তবে তা করতে হবে যৌক্তিক কারণ ও লিখিত অনুমোদনসহ।
- এই ধারা নিয়ে আদালত ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সমালোচনা রয়েছে, কারণ এটি ধারা ৫৪-এর মতোই অপব্যবহারের ঝুঁকি তৈরি করে।
৬. পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার: বাস্তব চিত্র ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে বহু মানবাধিকার সংস্থা যেমন Ain o Salish Kendra (ASK), Odhikar ইত্যাদি প্রতিবছর রিপোর্ট প্রকাশ করে যেখানে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার, জোরপূর্বক জিজ্ঞাসাবাদ ও রিমান্ডে নির্যাতন করে থাকে।
এই প্রবণতা কেবল নাগরিক অধিকারের লঙ্ঘন নয়, বরং বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনআস্থার ক্ষতি ঘটায়।
আইনবিদদের মতে, পুলিশের ক্ষমতা সীমিত রাখতে হলে—
- গ্রেফতারের প্রতিটি ঘটনা নিরপেক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ,
- সিসিটিভি মনিটরিং,
- এবং অভিযোগ তদন্তে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
৭. উপসংহার (Conclusion)
পুলিশের গ্রেফতার ও জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষমতা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য অপরিহার্য হলেও, তার অপব্যবহার নাগরিক স্বাধীনতার জন্য ক্ষতিকর। বাংলাদেশের আইন ও উচ্চ আদালতের ব্যাখ্যা এই ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ করেছে।
- বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার শর্তসাপেক্ষ ও যৌক্তিক কারণ ব্যতীত বৈধ নয়;
- জিজ্ঞাসাবাদের নামে অবৈধ আটক বা নির্যাতন সংবিধানবিরোধী;
- গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করা বাধ্যতামূলক;
- নাগরিকদের উচিত তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং প্রয়োজনে আইনি প্রতিকার গ্রহণ করা।
“আইনের প্রতি শ্রদ্ধা যেমন নাগরিকের দায়িত্ব, তেমনি আইনের সীমা মানা পুলিশেরও কর্তব্য। সচেতন নাগরিকই পারে আইনের শাসনকে বাস্তবে রূপ দিতে।”
তথ্যসূত্র (References)
- ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ (ধারা ৫৪, ৫৫, ৬১, ১৬৭, ২৯৬)
- দণ্ডবিধি, ১৮৬০
- বাংলাদেশ সংবিধান (অনুচ্ছেদ ৩২, ৩৩)
- ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ (ধারা ৪৩)
- BLAST বনাম বাংলাদেশ, ৫৫ DLR (HCD) ৩৬৩ (২০০৩)
- বিএনডব্লিউএমএ বনাম বাংলাদেশ, (২০১৬)
- আসাদুজ্জামান বনাম রাষ্ট্র, (২০১৮)
- রুবেল বনাম বাংলাদেশ, (২০২০)
- Bangladesh National Human Rights Commission Act, 2009
- Ain o Salish Kendra (ASK) Annual Human Rights Reports (2019–2024)
✍️ লেখক পরিচিতি
নাজমুল আলম অপু
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
আইন ও সমাজবিষয়ক ব্লগার, আইনি সচেতনতা বিষয়ক লেখক ও বিশ্লেষক