🏠 পার্শ্ববর্তী জমির মালিক বা বাড়িওয়ালা রাস্তা(Road) না দিলে আইনি প্রতিকার
(বাংলাদেশের ভূমি আইন, সিভিল কোর্ট ও হাইকোর্টের রেফারেন্সসহ সংক্ষিপ্ত গাইড)
১. ভূমিকা
বাংলাদেশে অনেক সময় দেখা যায় — কোনো জমি বা বাড়ি চারদিকে অন্যের জমি দ্বারা ঘেরা, ফলে মালিক নিজস্ব জমিতে ঢোকার রাস্তা পান না। আবার অনেক ক্ষেত্রে বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়াকে প্রয়োজনীয় রাস্তা ব্যবহার করতে বাধা দেন। এসব পরিস্থিতিতে আইন অনুযায়ী রাস্তা ব্যবহারের অধিকার (Right of Way) প্রতিষ্ঠার স্পষ্ট বিধান আছে। নিচে তা ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করা হলো।

২. আইনি ভিত্তি (Legal Foundation)
(ক) State Acquisition and Tenancy Act, 1950 (ধারা 88-89):
এই আইনে বলা হয়েছে — প্রতিটি জমির মালিকের জমিতে প্রবেশ ও বাহির হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় রাস্তা ব্যবহারের অধিকার আছে। যদি কোনো জমি চারদিক থেকে বন্ধ থাকে (landlocked property), তবে মালিক পার্শ্ববর্তী জমি দিয়ে রাস্তা নেওয়ার আবেদন করতে পারেন।
(খ) Easement Act, 1882 (ধারা 13 ও 15):
এই আইন অনুযায়ী কেউ যদি ২০ বছর ধরে নিয়মিতভাবে পার্শ্ববর্তী জমি দিয়ে রাস্তা ব্যবহার করেন এবং জমির মালিক কোনো আপত্তি না তোলেন, তাহলে তিনি স্থায়ী রাস্তার অধিকার (Prescriptive Easement Right) লাভ করেন।
উদাহরণ: আপনি যদি ২০ বছর ধরে একই পথ দিয়ে যাতায়াত করে থাকেন এবং জমির মালিক কিছু বলেননি, তাহলে আইন আপনাকে সেই রাস্তা ব্যবহারের অধিকার দেবে।
৩. আইনি প্রতিকার পাওয়ার ধাপ (Legal Steps)
ধাপ ১: লিগ্যাল নোটিশ প্রেরণ (Legal Notice)
প্রথমে পার্শ্ববর্তী জমির মালিককে লিখিতভাবে জানান যে আপনি তাঁর জমির উপর দিয়ে রাস্তা ব্যবহারের অধিকার চান।
- নোটিশে উল্লেখ করতে হবে — রাস্তার প্রয়োজনীয়তা ও বিকল্প রাস্তা না থাকার কারণ।
- নোটিশ পাঠানোর পর অন্তত ১৫ দিনের সময় দিন প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য।
👉 উল্লেখ্য: এটি একটি প্রাথমিক আইনি সতর্কতা, যা ভবিষ্যতের মামলা বা প্রমাণ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ধাপ ২: স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা চাওয়া
যদি নোটিশে সাড়া না মেলে, তবে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভায় লিখিত আবেদন করতে পারেন। স্থানীয় সরকার আইন অনুযায়ী প্রশাসন উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে রাস্তা নির্ধারণের সুপারিশ দিতে পারে।
📚 মামলার রেফারেন্স:
- মো. আলী vs. জেলা প্রশাসক (২০১৮, ৬০ DLR) — আদালত বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ আইন অনুযায়ী জনস্বার্থে রাস্তা নির্ধারণ করতে পারে।
ধাপ ৩: সিভিল কোর্টে মামলা দায়ের (Civil Suit)
যদি স্থানীয় সমাধান না হয়, তাহলে সিভিল কোর্টে মামলা করা যায়।
- Specific Relief Act, 1877 (ধারা 8 ও 9) অনুযায়ী আদালতের মাধ্যমে রাস্তার অধিকার দাবি করা যায়।
- আদালত চাইলে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা (Temporary Injunction) জারি করতে পারে যাতে অন্য পক্ষ রাস্তা বন্ধ করতে না পারে।
📚 উল্লেখযোগ্য রায়:
- সুজাতা বেগম vs. রফিকুল ইসলাম (২০১৯, ৬৫ DLR) — আদালত রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া মালিককে বাধ্য করেছেন রাস্তা খুলে দিতে।
৪. হাইকোর্টের নির্দেশনা ও রায়সমূহ
(ক) রিট পিটিশন (সংবিধানের আর্টিকেল ১০২ অনুযায়ী):
যদি প্রশাসন বা স্থানীয় সরকার সংস্থা দায়িত্ব না নেয়, তাহলে হাইকোর্টে রিট মামলা করা যায়।
- বাংলাদেশ vs. মো. হাসান (২০২০, ৭২ DLR HCD) মামলায় হাইকোর্ট স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেন যেন জনস্বার্থে রাস্তা তৈরি ও সংরক্ষণ নিশ্চিত করা হয়।
(খ) সরকারি রাস্তা দখল বা বাধা দিলে:
- আব্দুল মান্নান vs. জমিদার সমিতি (২০২১, HCD) — হাইকোর্ট জবরদখলকৃত সরকারি রাস্তা পুনরুদ্ধারের নির্দেশ দেন।
৫. ভূমি রেকর্ড ও দলিল যাচাই (Land Record & Documents)
- আপনার জমির CS, SA, RS ও BS ম্যাপ দেখে নিশ্চিত করুন রাস্তা খাস জমি নাকি বেসরকারি।
- রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট, 1908 (ধারা 17) অনুযায়ী, কোনো জমি বিক্রির দলিলে রাস্তার অংশ বা প্রবেশপথ থাকলে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হয়।
৬. বিশেষ পরিস্থিতি অনুযায়ী করণীয়
(ক) বাড়িওয়ালা যদি রাস্তা না দেন (Landlord-Tenant Issue):
ভাড়াটিয়ার মৌলিক অধিকার হলো বাসযোগ্য পরিবেশে বসবাস করা।
- ভাড়া নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ অনুযায়ী, বাড়িওয়ালা এমন কোনো কাজ করতে পারবেন না যা ভাড়াটিয়ার চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে।
(খ) পারিবারিক বা অংশীদার জমির ক্ষেত্রে:
যদি রাস্তা পারিবারিক জমির অংশ হয়, তবে উত্তরাধিকারী সবাইকে নিয়ে সমঝোতা স্মারক (Deed of Understanding) করা যেতে পারে।
৭. প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
প্রশ্ন ১: পার্শ্ববর্তী মালিক রাস্তা বন্ধ করলে কী শাস্তি হতে পারে?
উত্তর: Criminal Procedure Code (CrPC) ধারা 134 অনুযায়ী রাস্তা বন্ধ করে জনসাধারণের ক্ষতি করলে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানা হতে পারে।
প্রশ্ন ২: আমি ২০ বছর ধরে একটি পথ ব্যবহার করছি, এখন তা বন্ধ করে দিয়েছে — আমি কি মামলা করতে পারব?
উত্তর: অবশ্যই পারেন। Easement Act, 1882 (ধারা 15) অনুযায়ী, আপনি “Prescriptive Right” অর্জন করেছেন, যা আদালত রক্ষা করবে।
প্রশ্ন ৩: বাড়িওয়ালা কি ভাড়াটিয়ার জন্য রাস্তা দিতে বাধ্য?
উত্তর: হ্যাঁ। বাসার চুক্তিতে রাস্তা বা প্রবেশপথ যদি বাদও থাকে, তাহলেও “বাসযোগ্য পরিবেশ” নিশ্চিত করা বাড়িওয়ালার দায়িত্ব।
৮. উপসংহার (Conclusion)
বাংলাদেশের আইন অনুসারে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অন্যের চলাচলের বৈধ অধিকার বাধাগ্রস্ত করতে পারে না। জমি হোক বা বাড়ি — যদি প্রবেশের পথ বন্ধ করা হয়, তাহলে নোটিশ, প্রশাসনিক আবেদন, বা আদালতের মাধ্যমে আইনি প্রতিকার নেওয়া যায়।
একটি বিষয় মনে রাখতে হবে — রাস্তা সংক্রান্ত বিবাদে প্রথমে আলোচনা ও সমঝোতা চেষ্টা করা উচিত, কিন্তু প্রয়োজনে সিভিল কোর্ট বা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করাই শেষ আশ্রয়।
⚖️ মূল কথা: নিজের আইনগত অধিকার জানুন, দলিল ও ম্যাপ যাচাই করুন, এবং প্রয়োজনে অভিজ্ঞ ভূমি আইনজীবীর পরামর্শ নিন।
📘 লেখক: নাজমুল আলম অপু, আইনজীবী ও ব্লগার