পরকিয়া কি? পরকীয়ার কি শাস্তি হতে পারে? 2025

– বাংলাদেশের আইন, শরিয়া ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি

পরকিয়া কি? পরকীয়ার কি শাস্তি হতে পারে?

বাংলাদেশের আইন, শরিয়া ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি

“পরকিয়া” বা ব্যভিচার (Adultery) বাংলাদেশের সমাজে একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল ও নিন্দনীয় বিষয়। এটি ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক বন্ধন এবং সামাজিক মূল্যবোধকে গভীরভাবে আঘাত করে। কিন্তু আইনের দৃষ্টিতে এর পরিণতি কী? বাংলাদেশের প্রচলিত আইন, ফৌজদারি বিধি, মুসলিম পারিবারিক আইন এবং উচ্চ আদালতের রায় কী বলে? আসুন বিস্তারিত জেনে নিই।

পরকিয়া বা ব্যভিচার কি?

পরকিয়া সাধারণত একজন বিবাহিত ব্যক্তির তার বিবাহিত সঙ্গী ছাড়া অন্য কোনও ব্যক্তির সাথে সম্মতিতে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করাকে বোঝায়। এটি বিশ্বাসঘাতকতা, ধর্ষণ নয় (যা সম্পূর্ণ ভিন্ন ও কঠিন অপরাধ)।

বাংলাদেশে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক (Extra-Marital Relationship) একটি জটিল ও সংবেদনশীল বিষয়। আইন, ধর্ম, সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধের টানাপোড়েনে এর আইনগত পরিণতি সম্পর্কে অনেকেরই স্বচ্ছ ধারণা নেই। আসুন বিস্তারিত জেনে নিই:

 ১. ফৌজদারি আইনের দৃষ্টিকোণ (দণ্ডবিধি, ১৮৬০)

🔹 ধারা ৪৯৭: ব্যভিচার (Adultery)

– পরিধি: শুধুমাত্র বিবাহিত নারীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনকারী পুরুষের বিরুদ্ধে প্রযোজ্য

– শর্ত:

  – নারীটি বিবাহিত হওয়া

  – তার স্বামীর সম্মতি ছাড়া সম্পর্ক

  – পুরুষটির এই জ্ঞান থাকা যে নারীটি বিবাহিত

– শাস্তি: সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয়ই

🔹 ধারা ৪৯৮: স্বামী/স্ত্রীকে প্রলোভন

– বিবাহিত ব্যক্তিকে তার সঙ্গীর কাছ থেকে সরানোর চেষ্টা করলে

– শাস্তি: সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদণ্ড বা জরিমানা

🔹 গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা:

– নারী অংশগ্রহণকারীকে সরাসরি শাস্তির বিধান নেই

– প্রমাণের কঠোরতা ও সামাজিক চাপে মামলা বিরল

– উচ্চ আদালতের রায় (যেমন: ২০১৯ সালের একটি রিট) অনুসারে, প্রাপ্তবয়স্কদের সম্মতিজনিত ব্যক্তিগত সম্পর্কে পুলিশ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।

২. মুসলিম পারিবারিক আইন, ১৯৬১

– তালাকের ভিত্তি: বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক তালাক (স্বামীর পক্ষে) বা খুলা (স্ত্রীর পক্ষে) এর বৈধ কারণ

– ইদ্দত ভরণপোষণ: ব্যভিচার প্রমাণিত হলে স্ত্রীর ইদ্দত ভরণপোষণ লাভের অধিকার হারায়

– মহরানা: সম্পর্ক প্রমাণিত হলে মহরানা দাবির অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়

৩. বিশেষ বিবাহ আইন ও অন্যান্য

– বহু বিবাহ (ধারা ৪৯৪): বিবাহিত পুরুষ যদি দ্বিতীয় বিয়ে করে এবং প্রথম স্ত্রীকে না জানায়, তা শাস্তিযোগ্য (৭ বছর কারাদণ্ড)

– ধর্ষণ (ধারা ৩৭৫): সম্মতি ছাড়া সম্পর্ক স্থাপন ধর্ষণ হিসেবে শাস্তিযোগ্য

– অপহরণ (ধারা ৩৬৬): জোরপূর্বক সঙ্গী অপসারণ শাস্তিযোগ্য

৪. উচ্চ আদালতের দৃষ্টিভঙ্গি

– ব্যক্তিগত স্বাধীনতা: হাইকোর্ট বারবার রায় দিয়েছে যে প্রাপ্তবয়স্কদের সম্মতিজনিত সম্পর্ক ফৌজদারি অপরাধ নয় (রিট পেটিশন নং ১০১৩৭/২০১৬)

– পুলিশ হস্তক্ষেপ নিষেধ: আদালত নির্দেশ দিয়েছে যে প্রেমের সম্পর্ক বা লিভ-ইন রিলেশনশিপে পুলিশ বেআইনি হস্তক্ষেপ করতে পারবে না

– মিথ্যা মামলা সতর্কতা: সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর মিথ্যা মামলা দায়ের করলে তা হয়রানিমূলক মামলা হিসেবে গণ্য হতে পারে

৫. সিভিল আইনে প্রভাব

– তালাক: সম্পর্ক প্রমাণিত হলে দ্রুত তালাক মঞ্জুর

– সন্তানের হেফাজত: বাবা/মায়ের চরিত্র বিচার করে হেফাজত নির্ধারণ

– সম্পত্তির অধিকার: বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক থেকে জন্ম নেওয়া সন্তানের উত্তরাধিকার সীমিত (মুসলিম আইনে)

৬. সামাজিক শাস্তি (আইনের বাইরে)

– পারিবারিক ও সামাজিক বহিষ্কার

– চাকরি হারানো বা ব্যবসায় ক্ষতি

– মানসিক নির্যাতন ও শারীরিক আক্রমণ (যা সম্পূর্ণ বেআইনি)

– সম্মানহানি ও সামাজিক কলঙ্ক

পরকীয়া

৭. বাস্তব চ্যালেঞ্জ

– প্রমাণের বোঝা: ফৌজদারি আদালতে ব্যভিচার প্রমাণ করা অত্যন্ত কঠিন

– সামাজিক চাপ: মামলা করলে পরিবারের “সম্মানহানি”র ভয়ে অনেকে আইনের আশ্রয় নেয় না

– লিঙ্গপক্ষপাত: আইন ও সমাজ উভয় ক্ষেত্রেই নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি

উপসংহার:

বাংলাদেশে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের সরাসরি ফৌজদারি শাস্তি সীমিত ও প্রায়োগিকভাবে দুর্বল। যদিও দণ্ডবিধির ধারা ৪৯৭ ও ৪৯৮ বিদ্যমান, কিন্তু উচ্চ আদালতের রায় ও সামাজিক বাস্তবতায় এর প্রয়োগ নগণ্য। প্রকৃত শাস্তি আসে সামাজিক ও পারিবারিক স্তরে – সম্পর্কচ্ছেদ, সম্মানহানি ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা।

⚠️ সতর্কবাণী:

– কারও বিরুদ্ধে বেআইনি ভাবে শারীরিক নির্যাতন বা “সমাজিক বিচার” করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ

– মিথ্যা মামলা দায়ের করলে হয়রানির মামলার মুখোমুখি হতে হবে

– যেকোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আগে আইনজীবীর পরামর্শ আবশ্যক

লিগ্যাল নোট:এই ব্লগ সাধারণ আইনি তথ্য প্রদান করে, যা আইনি পরামর্শ নয়। নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করুন। বাংলাদেশের আইন ও বিচারব্যবস্থা সময়ের সাথে বিবর্তনশীল।

লেখক

নাজমুল আলম অপু

এডভোকেট

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

মোবাইলঃ ০১৬৮০১৯১৯৯১, ০১৭১৫-৯৯০৭৪১।

৬. সামাজিক শাস্তি (আইনের বাইরে)

  • পারিবারিক ও সামাজিক বহিষ্কার
  • চাকরি হারানো বা ব্যবসায় ক্ষতি
  • মানসিক নির্যাতন ও শারীরিক আক্রমণ (যা সম্পূর্ণ বেআইনি)
  • সম্মানহানি ও সামাজিক কলঙ্ক

৭. বাস্তব চ্যালেঞ্জ

  • প্রমাণের বোঝা: ফৌজদারি আদালতে ব্যভিচার প্রমাণ করা অত্যন্ত কঠিন
  • সামাজিক চাপ: মামলা করলে পরিবারের “সম্মানহানি”র ভয়ে অনেকে আইনের আশ্রয় নেয় না
  • লিঙ্গপক্ষপাত: আইন ও সমাজ উভয় ক্ষেত্রেই নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি

উপসংহার:

বাংলাদেশে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের সরাসরি ফৌজদারি শাস্তি সীমিত ও প্রায়োগিকভাবে দুর্বল। যদিও দণ্ডবিধির ধারা ৪৯৭ ও ৪৯৮ বিদ্যমান, কিন্তু উচ্চ আদালতের রায় ও সামাজিক বাস্তবতায় এর প্রয়োগ নগণ্য। প্রকৃত শাস্তি আসে সামাজিক ও পারিবারিক স্তরে – সম্পর্কচ্ছেদ, সম্মানহানি ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা।

⚠️ সতর্কবাণী:

  • কারও বিরুদ্ধে বেআইনি ভাবে শারীরিক নির্যাতন বা “সমাজিক বিচার” করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ
  • মিথ্যা মামলা দায়ের করলে হয়রানির মামলার মুখোমুখি হতে হবে
  • যেকোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আগে আইনজীবীর পরামর্শ আবশ্যক

লিগ্যাল নোট:এই ব্লগ সাধারণ আইনি তথ্য প্রদান করে, যা আইনি পরামর্শ নয়। নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করুন। বাংলাদেশের আইন ও বিচারব্যবস্থা সময়ের সাথে বিবর্তনশীল।

লেখক-

নাজমুল আলম অপু

এডভোকেট

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

মোবাইলঃ ০১৬৮০-১৯১৯৯১, ০১৭১৫-৯৯০৭৪১।

This Post Has 2 Comments

Leave a Reply