থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার এজাহার প্রাপ্তির পর ফৌজদারী কার্যবিধি বিধান অনুযায়ী কি কি ব্যাবস্থা গ্রহণ করবেন? (What action will be taken by an Officer -in -Charge of a police station on receipet of such FIR in accordance with the provision of the Code Of Criminal Procedure?)

লেখক: এডভোকেট নাজমুল আলম অপু

ভূমিকা

পুলিশ

বাংলাদেশের ফৌজদারী বিচারব্যবস্থার প্রাথমিক ধাপ শুরু হয় থানায় এজাহার (First Information Report – F.I.R.) দায়েরের মাধ্যমে। কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে এমন সংবাদ বা তথ্য থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (Officer-in-Charge, O.C.) প্রাপ্ত হলে তিনি ফৌজদারী কার্যবিধি (Code of Criminal Procedure, 1898) অনুযায়ী নির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য।
এজাহার দাখিলের পর পুলিশ কর্মকর্তার কর্মকাণ্ডের সীমা, দায়িত্ব ও তদন্ত প্রক্রিয়া আইন দ্বারা স্পষ্টভাবে নির্ধারিত।
এই লেখায় ধারা ১৫৪, ১৫৫, ১৫৭, ১৫৮, ১৫৯, ১৬১, ১৬৫ ও ১৭৩ অনুযায়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার করণীয় বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হলো।

ধারা ১৫৪ — জ্ঞাতব্য অপরাধের সংবাদ (Information in cognizable cases)

ধারা ১৫৪ অনুসারে, যদি কোনো ব্যক্তি মৌখিক বা লিখিতভাবে থানায় এসে জ্ঞাতব্য অপরাধ (Cognizable offence) সম্পর্কে তথ্য প্রদান করেন, তবে থানার অফিসার সেই তথ্য লিখিত আকারে নেবেন এবং তা পড়া শেষে তথ্যদাতার স্বাক্ষর গ্রহণ করবেন।
এই লিখিত নথিকেই বলা হয় এজাহার বা F.I.R. (First Information Report)

👉 মূল বিধান:

“Every information relating to the commission of a cognizable offence, if given orally to an officer in charge of a police station, shall be reduced to writing by him… and be signed by the person giving it.”

📘 কেস ল:

  • 42 DLR (AD) 32 – State vs. Abul Kalam Azad: আদালত বলেন, “জ্ঞাতব্য অপরাধের ক্ষেত্রে এজাহার গ্রহণ না করা আইন লঙ্ঘন।”
  • 1990 CrLJ 181 – Abdul Kader vs. State: আদালত উল্লেখ করেন যে, এজাহার গ্রহণ পুলিশ কর্মকর্তার আইনগত দায়িত্ব; তিনি তদন্ত এড়িয়ে যেতে পারেন না।

অতএব, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার প্রথম দায়িত্ব হলো — এজাহার লিপিবদ্ধ করা নথিভুক্তি নম্বর প্রদান করা।

ধারা ১৫৫ — অজ্ঞাতব্য অপরাধ (Non-cognizable offence) এর ক্ষেত্রে করণীয়

যদি কোনো অপরাধ অজ্ঞাতব্য প্রকৃতির হয় (যেখানে পুলিশ ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেপ্তার করতে পারে না), তবে ধারা ১৫৫ অনুযায়ী অফিসার নিজে তদন্ত করতে পারেন না।
এক্ষেত্রে তিনি তথ্য লিপিবদ্ধ করবেন এবং ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত কোনো তদন্ত করতে পারবেন না।

👉 মূল বিধান:

“No police officer shall investigate a non-cognizable case without the order of a Magistrate having power to try such case.”

📘 কেস ল:

  • 31 DLR (HCD) 125 – Nurul Islam vs. State: হাইকোর্ট বলেন, “অজ্ঞাতব্য অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের পূর্বানুমতি ছাড়া তদন্ত করলে সেই তদন্ত অবৈধ।”

সুতরাং, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রথমে নির্ধারণ করবেন—অপরাধটি জ্ঞাতব্য না অজ্ঞাতব্য; তারপর আইনি বিধান অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবেন।

ধারা ১৫৭ — প্রাথমিক তদন্ত ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রতিবেদন প্রেরণ

ধারা ১৫৭ অনুযায়ী, এজাহার পাওয়ার পর যদি অফিসার মনে করেন যে অভিযোগটি সত্য এবং তদন্তের যোগ্য, তবে তিনি তদন্ত শুরু করবেন এবং একইসাথে ম্যাজিস্ট্রেটকে একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন (Preliminary Report) প্রেরণ করবেন।
এই ধারা পুলিশের তদন্তের প্রাথমিক ধাপ নির্ধারণ করে।

👉 মূল বিধান:

“If, from information received or otherwise, an officer in charge of a police station has reason to suspect the commission of an offence… he shall forthwith send a report to a Magistrate empowered to take cognizance of such offence and shall proceed in person to investigate the facts and circumstances.”

📘 কেস ল:

  • NRL 1997 CrLJ: আদালত বলেন, “তদন্তে বিলম্ব বা প্রাথমিক প্রতিবেদন না পাঠানো তদন্তের স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।”
  • State vs. Md. Anwar Hossain, 48 DLR (HCD) 140: “পুলিশ অফিসারকে ধারা ১৫৭ অনুযায়ী যথাসময়ে ম্যাজিস্ট্রেটকে অবহিত করতে হবে।”

ধারা ১৫৮ — প্রতিবেদন প্রেরণের পদ্ধতি

এই ধারা অনুযায়ী, তদন্তকারী অফিসার প্রাপ্ত এজাহারের অনুলিপি এবং প্রতিবেদন বিশেষ দূত বা সরকার নির্ধারিত পদ্ধতিতে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট পাঠাবেন।
এর উদ্দেশ্য হলো তদন্তের স্বচ্ছতা বজায় রাখা এবং বিচার বিভাগীয় তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করা।

👉 মূল বিধান:

“Every such report shall be sent to the Magistrate through such superior officer of police as the Government may by general or special order direct.”

📘 কেস ল:

  • State vs. Bashir Ahmed, 46 DLR (AD) 23: আদালত বলেন, “প্রতিবেদন প্রেরণে দেরি তদন্ত প্রক্রিয়াকে সন্দেহজনক করে তোলে।”

ধারা ১৫৯ — তদন্তের বিকল্প ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা

ধারা ১৫৯ অনুসারে, ম্যাজিস্ট্রেট প্রাপ্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নিতে পারেন:

  1. নিজে তদন্ত করতে পারেন,
  2. বা অন্য কোনো পুলিশ অফিসারকে তদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন,
  3. অথবা তদন্ত স্থগিত রাখার নির্দেশ দিতে পারেন যদি মনে হয় অভিযোগ ভিত্তিহীন।

এই ধারা পুলিশ তদন্তের উপর বিচারিক নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে।

📘 কেস ল:

  • State vs. Mir Hossain, 43 DLR (HCD) 45: আদালত বলেন, “ম্যাজিস্ট্রেট তদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন, কিন্তু পুলিশের নিজস্ব তদন্তে অযথা হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়।”

ধারা ১৬১ — সাক্ষীদের জবানবন্দি গ্রহণ (Examination of witnesses)

তদন্ত চলাকালে অফিসার সাক্ষীদের ডেকে তাদের মৌখিক বয়ান (Statement) গ্রহণ করবেন।
এই ধারা অনুযায়ী সাক্ষীদের জবানবন্দি আদালতে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহারযোগ্য নয়, তবে তদন্তে সহায়ক প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

👉 মূল বিধান:

“Any police officer making an investigation… may examine orally any person supposed to be acquainted with the facts and circumstances of the case.”

📘 কেস ল:

  • Bangladesh vs. Hasina Begum, 49 DLR (AD) 12: আদালত বলেন, “ধারা ১৬১ এর অধীনে দেওয়া বয়ান শুধুমাত্র তদন্তের উদ্দেশ্যে, বিচারকালে সাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য ব্যবহারযোগ্য।”

ধারা ১৬৫ — তল্লাশি জব্দ (Search and Seizure)

যদি তদন্তকারী অফিসার মনে করেন যে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ কোনো স্থানে সংরক্ষিত আছে, তবে তিনি ধারা ১৬৫ অনুযায়ী সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়াও তল্লাশি চালাতে পারেন, তবে এর জন্য লিখিতভাবে কারণ লিপিবদ্ধ করতে হবে।

👉 মূল বিধান:

“Whenever an officer in charge of a police station… has reasonable grounds for believing that anything necessary for the purposes of an investigation… may be found in any place, he may, after recording in writing the grounds of his belief, search or cause search to be made.”

📘 কেস ল:

  • State vs. Abdul Jalil, 44 DLR (AD) 60: আদালত বলেন, “তল্লাশির আগে কারণ লিখিতভাবে উল্লেখ না করা হলে সেই সার্চ অবৈধ।”

ধারা ১৭৩ — চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন (Final Report or Charge Sheet)

তদন্ত শেষ হলে অফিসার ধারা ১৭৩ অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে একটি Final Report বা Charge Sheet দাখিল করবেন।
এই প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকবে—

  1. অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না,
  2. কারা অভিযুক্ত,
  3. কোন সাক্ষ্য প্রাপ্ত হয়েছে,
  4. এবং মামলার উপসংহার।

👉 মূল বিধান:

“Every investigation… shall be completed without unnecessary delay, and the officer shall forward to the Magistrate a report in the prescribed form.”

📘 কেস ল:

  • State vs. Abdul Halim, 39 DLR (AD) 45: আদালত বলেন, “তদন্তে বিলম্ব বা চার্জশিটে ত্রুটি ন্যায়বিচারে প্রভাব ফেলে।”
  • High Court Directive 2003 (BLD 23 AD 140): “তদন্ত শেষ না করে পুলিশ মামলা নথিভুক্ত না রাখলে তা মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন।”

হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা নজির

বাংলাদেশের হাইকোর্ট বিভাগ একাধিক মামলায় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন:

  1. F.I.R. গ্রহণে গাফিলতি বা অস্বীকৃতি আইনবিরোধী42 DLR (AD) 32
  2. তদন্তে বিলম্ব করলে বিচার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়48 DLR (HCD) 140
  3. অজ্ঞাতব্য অপরাধে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়া তদন্ত অবৈধ31 DLR (HCD) 125
  4. তল্লাশি জব্দের ক্ষেত্রে কারণ লিখিতভাবে উল্লেখ বাধ্যতামূলক44 DLR (AD) 60
  5. তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে বিলম্ব ন্যায়বিচারের পরিপন্থী39 DLR (AD) 45

হাইকোর্টের এসব নির্দেশনা থানার অফিসারদের দায়িত্বশীলতা, নিরপেক্ষতা পেশাগত সততা বজায় রাখতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

তদন্তে পুলিশ কর্মকর্তার নৈতিক প্রশাসনিক দায়িত্ব

এজাহার প্রাপ্তির পর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নিম্নোক্ত নীতি অনুসরণ করতে হয়:

  1. অভিযোগকারীকে ন্যায়সঙ্গত আচরণ করা।
  2. নিরপেক্ষভাবে তদন্ত পরিচালনা করা।
  3. অভিযুক্তের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা।
  4. ম্যাজিস্ট্রেট ও আদালতের নির্দেশ যথাযথভাবে অনুসরণ করা।
  5. তদন্তে অপ্রয়োজনীয় বিলম্ব না করা।

এই নীতিগুলো বাংলাদেশ সংবিধানের ধারা ৩১, ৩৫ ৪৪ এর অধীনে ন্যায়বিচার ব্যক্তিস্বাধীনতার নিশ্চয়তা বহন করে।

উপসংহার

ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ১৫৪ থেকে ১৭৩ ধারাগুলো সম্মিলিতভাবে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কার্যাবলি ও তদন্ত প্রক্রিয়ার কাঠামো নির্ধারণ করেছে।
এজাহার প্রাপ্তির পর অফিসার যদি আইন অনুযায়ী দ্রুত ও সঠিক পদক্ষেপ নেন, তবে বিচারপ্রাপ্তি নিশ্চিত হয় এবং জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পায়।
অপরদিকে, বিলম্ব, পক্ষপাত বা অবহেলা বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের বিশ্বাসকে দুর্বল করে।

অতএব, পুলিশের প্রতিটি তদন্ত আইনসম্মত, স্বচ্ছ এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া আবশ্যক।
এটাই ন্যায়বিচারের প্রকৃত ভিত্তি এবং ফৌজদারী আইনের উদ্দেশ্য।

লেখক:
এডভোকেট নাজমুল আলম অপু
(
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট)

Leave a Reply