চুক্তিপত্র ছাড়া চেক ডিজঅনার মামলা করার আইনি বিশ্লেষণ
(বাংলাদেশের নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্টস অ্যাক্ট, আদালতের রায় ও প্রমাণের মানদণ্ডের আলোকে)
১. ভূমিকা
বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ব্যক্তিগত লেনদেনে চেক এখন একটি বহুল ব্যবহৃত অর্থপ্রদানের মাধ্যম। তবে চেক ফেরত বা ডিশনার (Dishonour) হলে, অনেকেই ধারণা করেন যে মামলার জন্য একটি চুক্তিপত্র (Written Agreement) থাকা বাধ্যতামূলক। প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশের আইনে এই ধারণা পুরোপুরি সঠিক নয়। চেকের আইনি বাধ্যবাধকতা নির্ভর করে দেনা বা দায় (Legally Enforceable Debt or Liability)-এর অস্তিত্বের ওপর, চুক্তিপত্রের ওপর নয়।

২. নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্টস অ্যাক্ট, ১৮৮১-এর প্রাসঙ্গিক ধারা
ধারা ১৩৮: চেক ডিশনার সংক্রান্ত অপরাধ
এই ধারায় বলা হয়েছে —
যদি কেউ চেক ইস্যু করে এবং সেই চেক ব্যাংক দ্বারা “অপর্যাপ্ত অর্থ” বা “অ্যাকাউন্ট ক্লোজড” ইত্যাদি কারণে ফেরত আসে, তবে সেটি একটি ফৌজদারি অপরাধ।
এই ধারা অনুযায়ী, অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হলে জরিমানা, কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
তবে এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো — আইন কোথাও “চুক্তিপত্র” শব্দটি ব্যবহার করেনি। বরং বলা হয়েছে, চেকটি অবশ্যই “আইনগত দায় পরিশোধের উদ্দেশ্যে” ইস্যু করা হতে হবে।
ধারা ১১৮(এ): আইনি অনুমান (Presumption)
এই ধারায় বলা হয়েছে, আদালত প্রাথমিকভাবে ধরে নেবে যে—
“প্রত্যেক নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট, যেমন চেক, প্রযোজ্য দায় বা ঋণ পরিশোধের উদ্দেশ্যেই ইস্যু করা হয়েছে।”
অর্থাৎ, চেক হাতে পাওয়া ব্যক্তি (বাদী)কে প্রথমে দায় প্রমাণ করতে হয় না; বরং অভিযুক্ত (প্রতিপক্ষ)কে প্রমাণ করতে হয় যে চেকটি দায় পরিশোধের জন্য দেওয়া হয়নি — যেমন “সিকিউরিটি চেক”, “বন্ধুত্বের নিদর্শন”, বা “ব্ল্যাঙ্ক চেক” ছিল।
৩. চুক্তিপত্র না থাকলে মামলার গ্রহণযোগ্যতা
চুক্তিপত্রের অনুপস্থিতি চেক ডিজঅনার মামলার প্রতিবন্ধক নয়। তবে বাদীকে অবশ্যই দেখাতে হবে যে—
চেকের মাধ্যমে যেই অর্থ দাবিকৃত, তা কোনো আইনগত দেনা বা দায় এর অংশ। এই প্রমাণ নিম্নলিখিত উপায়ে দেওয়া যায়:
১️⃣ লেনদেনের রসিদ বা ইনভয়েস:
যদি চেকটি কোনো পণ্য বিক্রয় বা সেবা প্রদানের বিনিময়ে দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে সেই লেনদেনের ইনভয়েস, ডেলিভারি চালান, বা পেমেন্ট রসিদ প্রমাণ হিসেবে দাখিল করা যায়।
২️⃣ ডিজিটাল যোগাযোগ:
ইমেইল, এসএমএস, হোয়াটসঅ্যাপ বা ব্যাংক ট্রান্সফারের স্ক্রিনশটও প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য (Evidence Act অনুযায়ী)।
৩️⃣ সাক্ষীর সাক্ষ্য:
লেনদেনের সময় উপস্থিত ব্যক্তি বা ব্যবসার সহযোগীর সাক্ষ্যও চেক ইস্যুর পটভূমি প্রমাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৪️⃣ ব্যাংক স্টেটমেন্ট বা হিসাব খাতা:
যদি ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ প্রদান করা হয়ে থাকে, তবে ব্যাংক স্টেটমেন্ট একটি শক্তিশালী প্রমাণ হিসেবে গৃহীত হয়।
৪. আদালতের রায় ও দৃষ্টান্ত
বাংলাদেশের আদালত একাধিক রায়ে পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে চেক ডিজঅনার মামলার জন্য লিখিত চুক্তিপত্র বাধ্যতামূলক নয়। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রায় তুলে ধরা হলো:
- Md. Siddikur Rahman vs State (2017) —
হাইকোর্ট বলেছেন, “চেক ইস্যুর উদ্দেশ্য যদি দায় পরিশোধ হয় এবং তা প্রমাণিত হয়, তবে লিখিত চুক্তিপত্র না থাকলেও মামলা চলবে।” - Al-Amin vs Premier Bank Ltd (2023) —
আদালত রায় দেয়, “চেকের স্বাক্ষর ও ইস্যুর তারিখ প্রমাণযোগ্য হলে, চুক্তির অনুপস্থিতি মামলার গ্রহণযোগ্যতাকে বাতিল করে না।” - State vs Abdul Jalil (2015) —
আদালত উল্লেখ করেন যে, “আইনি দায়ের অস্তিত্ব মৌখিক, লিখিত বা আচরণগত — যেকোনো মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা যায়।”
এই রায়গুলো প্রমাণ করে, চেক ডিশনার মামলায় মূল প্রশ্ন হলো — চেকটি কীভাবে এবং কেন দেওয়া হয়েছে? — এর উত্তরই দায় প্রমাণের ভিত্তি।
৫. প্রতিপক্ষের সম্ভাব্য যুক্তি ও মোকাবিলা
প্রতিপক্ষ সাধারণত কয়েকটি প্রচলিত যুক্তি দিয়ে দায় অস্বীকার করতে পারে:
১️⃣ চেকটি সিকিউরিটি হিসেবে দেওয়া হয়েছিল
👉 প্রতিকার: বাদীকে দেখাতে হবে যে চেক ইস্যুর সময় আসলে কোনো দেনা বা লেনদেন চলমান ছিল। ব্যবসায়িক ইনভয়েস, পেমেন্ট রেকর্ড ইত্যাদি এই যুক্তি খণ্ডন করতে সক্ষম।
২️⃣ চেকটি ব্ল্যাঙ্ক অবস্থায় স্বাক্ষর করা হয়েছিল
👉 প্রতিকার: নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্টস অ্যাক্টের ধারা ২০ অনুযায়ী, এমন চেকও বৈধ, যদি তা দায় পরিশোধের উদ্দেশ্যে ইস্যু করা হয়।
৩️⃣ চেকটি প্রতারণামূলকভাবে নেওয়া হয়েছে
👉 প্রতিকার: এ ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে প্রতারণার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দেখাতে হবে। কেবল অভিযোগ করলেই আদালত তা গ্রহণ করবে না।
৬. প্রমাণের ভার (Burden of Proof)
আইনে বলা আছে —
প্রাথমিকভাবে আদালত ধরে নেবে চেকের পেছনে একটি আইনগত দায় রয়েছে।
অতএব, প্রথমে দায় প্রমাণ করার দায়িত্ব প্রতিপক্ষের। তবে একবার যদি প্রতিপক্ষ যুক্তিযুক্ত সন্দেহ তৈরি করতে পারে, তখন বাদীকেই অতিরিক্ত প্রমাণ দিতে হয় (যেমন রসিদ, সাক্ষ্য ইত্যাদি)।
৭. ফৌজদারি ও দেওয়ানি প্রতিকার
চেক ডিশনার মামলা একটি ফৌজদারি অপরাধ। অভিযুক্ত দোষী হলে আদালত ১ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা চেকের দ্বিগুণ পর্যন্ত জরিমানা দিতে পারেন।
তবে যদি অভিযুক্ত দায় অস্বীকার করেন এবং বাদী অর্থ ফেরত পেতে চান, তাহলে সমান্তরালভাবে একটি দেওয়ানি মামলা (Suit for Money Recovery) করা যায়।
৮. আইনি প্রক্রিয়া ও সময়সীমা
চেক ডিশনার মামলায় সময়সীমা খুবই গুরুত্বপূর্ণ —
১️⃣ চেক ফেরত আসার তারিখ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে দাতাকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠাতে হবে।
২️⃣ নোটিশ পাওয়ার পর ১৫ দিনের মধ্যে যদি টাকা ফেরত না দেয়,
৩️⃣ তবে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে।
এই সময়সীমা অমান্য করলে মামলা গ্রহণযোগ্য হয় না।
৯. বাস্তব উদাহরণ (Hypothetical Case Example)
ধরা যাক, মি. রফিকুল ইসলাম তার বন্ধু মি. মনিরুজ্জামানকে ৫ লক্ষ টাকা ধার দেন, কোনো লিখিত চুক্তি ছাড়াই। কিছুদিন পর মনিরুজ্জামান একটি চেক দেন, যা ব্যাংকে জমা দিলে ফেরত আসে “অপর্যাপ্ত অর্থ” মন্তব্যসহ।
রফিকুল আইনজীবীর মাধ্যমে নোটিশ পাঠান এবং পরে মামলা করেন।
এক্ষেত্রে আদালত দেখবেন—
- চেকের স্বাক্ষর কি বৈধ?
- আসলেই কি কোনো দেনা ছিল?
যদি বাদী সাক্ষ্য ও ব্যাংক রেকর্ডের মাধ্যমে দেনা প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে লিখিত চুক্তি না থাকলেও মনিরুজ্জামান দোষী সাব্যস্ত হবেন।
১০. আইনজীবীদের জন্য পরামর্শ
১️⃣ সবসময় চেকের ফটোকপি ও ব্যাংক ফেরত মেমো সংরক্ষণ করুন।
২️⃣ নোটিশ পাঠানোর তারিখ ও ডেলিভারির রসিদ রাখুন।
৩️⃣ প্রয়োজনে মৌখিক চুক্তির সাক্ষীদের নাম বাদীপক্ষে উল্লেখ করুন।
৪️⃣ দেওয়ানি মামলা ও ফৌজদারি মামলা একইসঙ্গে চালানো যেতে পারে।
১১. উপসংহার
বাংলাদেশের আইনে চেক ডিশনার মামলা করার জন্য চুক্তিপত্র বাধ্যতামূলক নয়। আইনের মূল লক্ষ্য হলো — “দেনা বা দায়ের অস্তিত্ব” প্রমাণ করা।
চেকটি যদি আইনগত দায় পরিশোধের উদ্দেশ্যে ইস্যু করা হয়ে থাকে এবং তা যথাযথভাবে প্রমাণ করা যায়, তবে বাদী চুক্তিপত্র ছাড়াই ১৮৮১ সালের নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্টস অ্যাক্টের আওতায় মামলা করতে পারবেন।
অতএব, প্রতিটি লেনদেনে দলিলপত্র সংরক্ষণ, লিগ্যাল নোটিশ সময়মতো পাঠানো, এবং প্রমাণ প্রস্তুত রাখাই সফল মামলার মূল চাবিকাঠি।
লেখক: অ্যাডভোকেট নাজমুল আলম অপু
(আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট)