কে এজাহার বা এফ আই আর (প্রাথমিক তথ্য বিবরণী) দায়ের করতে পারে? (Who may file F.I.R.).

লেখক: অ্যাডভোকেট নাজমুল আলম অপু
যোগাযোগ: ০১৭১৫৯৯০৭৪১, ০১৬৮০১৯১৯৯১

ভূমিকা

বাংলাদেশের অপরাধ বিচারব্যবস্থার অন্যতম সূচনা বিন্দু হলো এজাহার বা প্রথমিক তথ্য বিবরণী (F.I.R)। কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে সেটি তদন্তের প্রথম ধাপ হিসেবে থানায় যে লিখিত বা মৌখিক প্রতিবেদন প্রদান করা হয়, সেটিই এফ আই আর। এটি পুলিশের জন্য অপরাধ তদন্তের বৈধ ভিত্তি সৃষ্টি করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই এফ আই আর দায়ের করার অধিকার কার? আইন কি বলে? আদালত এর ব্যাখ্যা কী দিয়েছে? এই লেখায় বাংলাদেশের প্রযোজ্য আইন, বিধি, ও গুরুত্বপূর্ণ রায়ের আলোকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হলো।

এফ আই আর এর আইনি সংজ্ঞা

বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ (Code of Criminal Procedure, 1898) এর ধারা ১৫৪ অনুযায়ী,
যখন কোনো জ্ঞাতব্য অপরাধ (Cognizable Offence) সংঘটিত হওয়ার তথ্য কোনো পুলিশ স্টেশনের অফিসার-ইন-চার্জকে মৌখিক বা লিখিতভাবে প্রদান করা হয়, তখন তিনি তা লিখিত আকারে রূপান্তর করবেন এবং অভিযোগকারী সেটিতে স্বাক্ষর করবেন। এই লিখিত বিবরণকেই বলা হয় প্রথমিক তথ্য বিবরণী বা এফ আই আর।

এটি এমন একটি তথ্য যা পুলিশের তদন্ত কার্যক্রম শুরু করার আইনি ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

কে এফ আই আর দায়ের করতে পারে

বাংলাদেশের আইনে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই যে শুধুমাত্র ভুক্তভোগীই এফ আই আর দায়ের করতে পারবেন। যে কেউ যদি কোনো জ্ঞাতব্য অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে জানেন বা প্রত্যক্ষ করেন, তিনি থানায় গিয়ে এফ আই আর দায়ের করতে পারেন।

অর্থাৎ,
১. ভুক্তভোগী,
২. প্রত্যক্ষদর্শী,
৩. তৃতীয় কোনো নাগরিক,
৪. অভিভাবক বা প্রতিনিধি (যদি ভুক্তভোগী অপ্রাপ্তবয়স্ক বা অক্ষম হয়),
৫. সরকারি কর্মকর্তা,

— এদের যে কেউ এফ আই আর দায়ের করার অধিকার রাখেন।

পুলিশের দায়িত্ব

ফৌজদারি কার্যবিধি, ধারা ১৫৪ অনুসারে, যখনই কোনো জ্ঞাতব্য অপরাধের তথ্য থানায় আসে, পুলিশ কর্মকর্তা সেটি গ্রহণ করতে বাধ্য। তিনি অভিযোগ মৌখিকভাবে পেলে তা লিখিত করবেন, আর যদি লিখিত আকারে পাওয়া যায়, তা এফ আই আর রেজিস্টারে নথিভুক্ত করবেন।

বাংলাদেশ পুলিশ রেগুলেশন (Police Regulation Bengal, 1943) এর নিয়ম ২৩৪ তেও বলা হয়েছে যে, “যে কোনো ব্যক্তি জ্ঞাতব্য অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সংবাদ থানার অফিসার-ইন-চার্জকে মৌখিক বা লিখিতভাবে দিতে পারেন।”

আদালতের ব্যাখ্যা নজির

এফ আই আর দায়েরকারীর পরিচয় নিয়ে বাংলাদেশের আদালত একাধিকবার রায় প্রদান করেছেন, যেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে এফ আই আর দায়ের করার ক্ষেত্রে অভিযোগকারী ভুক্তভোগী হতে হবে—এমন কোনো শর্ত নেই।

১. State vs. Abdul Kader, 33 DLR (1981) 72
এই মামলায় হাইকোর্ট বলেন, এফ আই আর দায়েরের জন্য অভিযোগকারী অপরাধে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে এমন নয়। যে কেউ তথ্য দিতে পারেন, যদি সেই তথ্য সত্য ও অপরাধসংক্রান্ত হয়।

২. Abdul Jalil vs. State, 41 DLR (1989) 120
আদালত মত দেন, এফ আই আর দায়েরের মূল উদ্দেশ্য হলো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সংবাদ পুলিশকে জানানো, যাতে তদন্ত শুরু করা যায়। অভিযোগকারীর পরিচয় গৌণ বিষয়।

৩. State vs. Md. Selim, 47 DLR (1995) 500
এখানে আদালত বলেন, অভিযোগকারী যদি অপরাধ প্রত্যক্ষ না-ও করে থাকেন, তবে তার প্রদত্ত তথ্য যদি সত্য ও নির্ভরযোগ্য হয়, তবে সেটি বৈধ এফ আই আর হিসেবে গণ্য হবে।

৪. Jhantu and Others vs. State, 1 BCR 244
এই মামলায় হাইকোর্ট স্পষ্টভাবে বলেন, এফ আই আর দায়ের করার অধিকার শুধুমাত্র ভুক্তভোগীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; যে কোনো ব্যক্তি যদি অপরাধ সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য জানেন, তিনি আইনি প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য থানায় অভিযোগ দায়ের করতে পারেন।

৫. ILR 1945 Kar. 891
এই মামলায় আদালত বলেন, “The information of a cognizable offence may be given by any person who has knowledge of it, whether he is personally interested or not.” অর্থাৎ, ব্যক্তিগত স্বার্থ না থাকলেও অপরাধের সত্য তথ্য জানা থাকলে এফ আই আর দায়ের করা যায়।

৬. NRL 1997 Cri 146
এই মামলায় আদালত বলেন, এফ আই আর হলো তথ্যদাতার দায়িত্ববোধের প্রকাশ। অপরাধ দমন এবং জনস্বার্থে প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব অপরাধ সংঘটিত হলে তা অবহিত করা।

৭. 1990 CrLJ 181
এই মামলায় বলা হয়, এফ আই আর দায়েরের উদ্দেশ্য হলো তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু করা, তাই অভিযোগকারীকে প্রমাণ করতে হয় না যে তিনি সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত। তার তথ্য সত্য হলে সেটি গ্রহণযোগ্য।

৮. 42 DLR (AD) 32
এখানে আপিল বিভাগ উল্লেখ করেন যে, এফ আই আর দায়েরের ক্ষেত্রে পুলিশ কর্মকর্তার দায়িত্ব হলো অভিযোগ গ্রহণ করা, তা যাচাই করে তদন্ত করা, কিন্তু অভিযোগকারীর উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহের সুযোগ নেই যদি অপরাধের তথ্য স্পষ্ট থাকে।

ফৌজদারি কার্যবিধি এর ধারা ১৯৫-১৯৯ এর প্রাসঙ্গিকতা

বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ধারা ১৯৫ থেকে ১৯৯ পর্যন্ত কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে অভিযোগ দায়েরের সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ করেছে। এসব ধারা মূলত এমন অপরাধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যা আদালতের প্রক্রিয়া বা সরকারি কর্তব্যের সাথে সম্পর্কিত।

১. ধারা ১৯৫: আদালতের অবমাননা, মিথ্যা সাক্ষ্য বা নথি জাল সংক্রান্ত অপরাধে শুধুমাত্র সেই আদালত বা অনুমোদিত কর্মকর্তাই অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন।
২. ধারা ১৯৬: রাষ্ট্রবিরোধী বা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধে সরকার অনুমোদন ছাড়া মামলা শুরু করা যাবে না।
৩. ধারা ১৯৭: সরকারি কর্মকর্তা কর্তব্য পালনকালে অভিযুক্ত হলে সরকারের অনুমতি ব্যতীত মামলা করা যাবে না।
৪. ধারা ১৯৮: ব্যক্তিগত মানহানির মামলা দায়েরের জন্য শুধুমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিই অভিযোগ করতে পারবেন।
৫. ধারা ১৯৯: সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়েরের জন্য সরকারের অনুমতি প্রয়োজন।

এই ধারাগুলোর বাইরে সাধারণ অপরাধের ক্ষেত্রে এফ আই আর দায়েরের জন্য কোনো সীমাবদ্ধতা নেই; যে কেউ তথ্য প্রদান করতে পারেন।

সাধারণ আইন (Common Law) এর দৃষ্টিকোণ

Common Law অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো জ্ঞাতব্য অপরাধ সংঘটিত হতে দেখেন বা জানেন, তবে তিনি নৈতিক ও সামাজিকভাবে পুলিশকে তা জানাতে বাধ্য। এফ আই আর হলো সেই দায়িত্বের আইনগত প্রতিফলন। তাই Common Law ও বাংলাদেশের প্রচলিত আইন একইভাবে স্বীকৃতি দেয় যে, যে কেউ অপরাধ সম্পর্কে অবহিত হলে পুলিশকে জানাতে পারেন।

বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের আইনে এফ আই আর দায়েরের ক্ষেত্রে মূল বিষয় হলো তথ্যের সত্যতা, অভিযোগকারীর পরিচয় নয়। পুলিশ যেকোনো নাগরিকের কাছ থেকে অপরাধসংক্রান্ত তথ্য গ্রহণ করতে বাধ্য এবং তা তদন্তের মাধ্যমে যাচাই করবে। তবে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে, যেমন রাষ্ট্রবিরোধী কার্য, আদালতের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ, সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ইত্যাদিতে সরকারের অনুমোদন বা আদালতের অনুমতি প্রয়োজন হতে পারে।

তবে সাধারণ অপরাধ যেমন হত্যা, ডাকাতি, চুরি, ধর্ষণ, প্রতারণা ইত্যাদির ক্ষেত্রে যে কেউ এফ আই আর দায়ের করতে পারেন—সে প্রত্যক্ষদর্শী, সংবাদদাতা বা সমাজের সাধারণ নাগরিক যেই হোক না কেন।

উপসংহার

বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধি, পুলিশ রেগুলেশন, ও আদালতের ধারাবাহিক রায়ের আলোকে স্পষ্ট যে এফ আই আর দায়ের করার অধিকার সীমিত নয়। যেকোনো ব্যক্তি, যিনি অপরাধ সংঘটিত হওয়ার বিষয়ে জ্ঞাত, তিনি আইনত থানায় গিয়ে মৌখিক বা লিখিতভাবে তথ্য দিতে পারেন।

এটি শুধু আইনি অধিকার নয়, বরং সামাজিক দায়িত্বও। কারণ এফ আই আর দায়েরের মাধ্যমে অপরাধের তদন্ত শুরু হয়, যা সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ।

সূত্র:

  • ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ (ধারা ১৫৪, ১৯৫–১৯৯)
  • পুলিশ রেগুলেশন বেঙ্গল, ১৯৪৩ (নিয়ম ২৩৪)
  • 33 DLR 72; 41 DLR 120; 47 DLR 500; 42 DLR (AD) 32
  • 1990 CrLJ 181; NRL 1997 CRI 146; ILR 1945 Kar 891; 1 BCR 244

Leave a Reply