কায়মোকাম (Substitution) — বাংলাদেশের দেওয়ানি কার্যবিধি, ১৯০৮ এর আলোকে একটি বিশ্লেষণমূলক ব্যাখ্যা

লেখক: অ্যাডভোকেট নাজমুল আলম অপু

বাংলাদেশের দেওয়ানি বিচার ব্যবস্থায় “কায়মোকাম (Substitution)” একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বাধ্যতামূলক প্রক্রিয়া। কোনো মামলা চলাকালীন সময়ে বাদী বা বিবাদী মারা গেলে, মামলা বন্ধ হয়ে যায় না— বরং সেই মৃত পক্ষের আইনগত উত্তরাধিকারী বা প্রতিনিধি আদালতের নিকট আবেদন করে মামলাটির পরবর্তী ধাপ চালিয়ে যেতে পারেন। এই প্রক্রিয়াকেই বলা হয় কায়মোকাম। দেওয়ানি কার্যবিধি, ১৯০৮ (Code of Civil Procedure, 1908)-এর Order XXII এবং Order I Rule 10(2) কায়মোকাম সংক্রান্ত মূল বিধান নির্ধারণ করেছে।

Youtube.com

বাংলাদেশের হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার প্র্যাকটিস রুলসেও এই বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, যা আইনজীবীদের দৈনন্দিন মামলা পরিচালনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।


⚖️ কায়মোকাম (Substitution) বলতে কী বোঝায়?

“Substitution” শব্দের অর্থ হচ্ছে কোনো কিছুর স্থলাভিষিক্ত হওয়া বা জায়গা নেওয়া। দেওয়ানি মামলার ভাষায় — কোনো পক্ষ (বাদী বা বিবাদী) মারা গেলে, তার স্থানে তার আইনগত উত্তরাধিকারী (Legal Representative) বা অনুমোদিত প্রতিনিধি আদালতের অনুমতিতে রেকর্ডে যুক্ত হয় এবং মামলা চলতে থাকে।

বাংলাদেশের দেওয়ানি আইনে, যদি পক্ষের মৃত্যু হয় এবং মামলার “right to sue” বা “মামলার অধিকার” মৃত্যুর পরও অব্যাহত থাকে, তাহলে আদালত ঐ মামলাটি বাতিল না করে উত্তরাধিকারীকে রেকর্ডে আনার সুযোগ দেয়। এটি কেবল আদালতের ইচ্ছার বিষয় নয়— এটি একটি বাধ্যতামূলক আইনগত ধারা


📜 প্রযোজ্য আইন

কায়মোকাম সংক্রান্ত প্রযোজ্য আইনগুলো হলো—

  1. দেওয়ানি কার্যবিধি, ১৯০৮ (Code of Civil Procedure, 1908)
    • Order XXII (Death, Marriage and Insolvency of Parties)
    • Order I Rule 10(2) (প্রয়োজনীয় পক্ষ যোগ বা বাদ দেওয়ার ক্ষমতা)
  2. Limitation Act, 1908 — সময়সীমা নির্ধারণে প্রযোজ্য।
  3. বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট (হাইকোর্ট বিভাগ)-এর প্র্যাকটিস রুলস ও রেজিস্ট্রার নির্দেশনা।

📝 Order XXII — কায়মোকামের মূল বিধান

Order XXII অনুসারে —

  • যদি মামলার বাদী বা বিবাদী মারা যায় এবং মামলার অধিকার অব্যাহত থাকে, তবে মৃত্যুর ৯০ দিনের মধ্যে আইনগত উত্তরাধিকারী বা প্রতিনিধি আদালতে কায়মোকামের জন্য আবেদন করতে হবে।
  • নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আবেদন না করলে মামলা abatement বা অবরুদ্ধ/বাতিল হয়ে যায়।
  • এরপর Order XXII Rule 9 অনুসারে “setting aside abatement” এর আবেদন করা যায়, যা সাধারণত মৃত্যুর তারিখ থেকে ১৫০ দিনের মধ্যে করতে হয়।

এই সময়সীমা বাংলাদেশের দেওয়ানি আদালতে অত্যন্ত কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়। আদালত কেবল যথাযথ কারণ (sufficient cause) দেখানো হলে বিলম্ব মাফ করতে পারে।


🕒 সময়সীমা ও ধাপসমূহ

ধাপসময়সীমাআইন
কায়মোকাম আবেদনমৃত্যু থেকে ৯০ দিনের মধ্যেOrder XXII
মামলা বাতিল (Abatement)৯০ দিন পার হলে স্বয়ংক্রিয়Order XXII Rule 3-4
সেট–অ্যাসাইড আবেদনপরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে (মোট ১৫০ দিন)Order XXII Rule 9
বিলম্ব মাফের আবেদন (Delay condonation)১৫০ দিনের পরSection 5, Limitation Act

👉 এই সময়সীমা না মানলে মামলা আর চলতে পারে না — ফলে বাদী বা বিবাদীর আইনগত অধিকার হারিয়ে যেতে পারে।


🧾 কায়মোকাম আবেদনের প্রক্রিয়া (বাংলাদেশে)

১. আবেদনপত্র দাখিল
মৃত পক্ষের আইনগত উত্তরাধিকারী বা প্রতিনিধি একটি লিখিত আবেদন দাখিল করেন যেখানে উল্লেখ থাকবে:

  • মৃত পক্ষের নাম ও মৃত্যুর তারিখ
  • উত্তরাধিকারীর পরিচয় ও সম্পর্ক
  • কেন তাকে substitution করা উচিত।

২. প্রয়োজনীয় সংযুক্তি:

  • মৃত্যু সনদ
  • উত্তরাধিকার সনদ / জাতীয় পরিচয়পত্র
  • পারিবারিক সনদ বা ইউনিয়ন পরিষদের প্রত্যয়নপত্র
  • NOC বা সম্মতিপত্র (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে)।

৩. আদালতের প্রাথমিক যাচাই:
আদালত নথি যাচাই করে এবং প্রয়োজনে নোটিশ দিয়ে অন্য পক্ষকে শুনানির সুযোগ দেয়।

৪. আদেশ:
আদালত সন্তুষ্ট হলে উত্তরাধিকারীকে রেকর্ডে যুক্ত করে মামলাটি পুনরায় চালু করে।


⚠️ কায়মোকাম না করলে কী হয়?

  • যদি ৯০ দিনের মধ্যে কায়মোকাম আবেদন না করা হয়, মামলা স্বয়ংক্রিয়ভাবে abate হয়ে যায়।
  • এরপর set-aside abatement-এর আবেদন না করলে মামলাটি চূড়ান্তভাবে খারিজ হয়ে যেতে পারে
  • অনেক সময় বাদীপক্ষের মৃত্যু হলে এবং কায়মোকাম না করলে বিবাদীপক্ষের পক্ষে ডিক্রি চূড়ান্ত হয়ে যায়, যা ভবিষ্যতে আর চ্যালেঞ্জ করা যায় না।
  • বিলম্ব মাফের আবেদন করলেও আদালত সবসময় তা গ্রহণ করে না; যথাযথ কারণ না থাকলে আবেদন নাকচ হতে পারে।

🏛️ হাইকোর্ট বিভাগের প্র্যাকটিস নির্দেশনা

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট (হাইকোর্ট বিভাগ)-এর রেজিস্ট্রার অফিস এবং আদালত নিয়ম অনুযায়ী—

  • পক্ষ মারা গেলে অবিলম্বে আদালতকে অবহিত করতে হয়।
  • কায়মোকাম না করা পর্যন্ত মামলার কার্যক্রম স্থগিত থাকে।
  • সময়সীমা অতিক্রম হলে আদালত স্বয়ংক্রিয়ভাবে মামলা abate হিসেবে বিবেচনা করে।
  • বিলম্ব মাফের ক্ষেত্রে আবেদন যথাযথভাবে সমর্থিত হতে হবে (death certificate, heir list, reason for delay ইত্যাদি)।

📚 প্রাসঙ্গিক বাংলাদেশী রায় ও আইনি দৃষ্টান্ত

বাংলাদেশের হাইকোর্ট বিভাগ একাধিক রায়ে স্পষ্টভাবে বলেছে—

  • Order XXII এর বিধান বাধ্যতামূলক। সময়সীমা না মানলে আদালত স্বয়ংক্রিয়ভাবে মামলা abate ঘোষণা করতে পারে।
  • সেট–অ্যাসাইড আবেদনের ক্ষেত্রেও “sufficient cause” প্রমাণ করতে হবে। শুধু বিলম্ব হলেই বিলম্ব মাফ করা হয় না।
  • একজন উত্তরাধিকারী substitution-এর আবেদন না করলেও, আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে substitution আদেশ দিতে পারে— যদি তা ন্যায্য হয়।
  • কায়মোকাম সংক্রান্ত আবেদন সঠিকভাবে প্রস্তুত না হলে আদালত তা খারিজ করতে পারে

(উৎস: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্ট বিভাগের বিভিন্ন দেওয়ানি রায় ও রেজিস্ট্রার নির্দেশনা)


🧭 বাস্তবিক পরামর্শ (Lawyer ও Blogger দৃষ্টিকোণ থেকে)

  1. মৃত্যুর খবর পাওয়া মাত্রই কায়মোকাম আবেদনের প্রস্তুতি শুরু করুন।
  2. প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র আগে থেকেই সংগ্রহে রাখুন — বিশেষত মৃত্যু সনদ ও উত্তরাধিকার সনদ।
  3. ৯০ দিনের সময়সীমা পেরিয়ে গেলে একসাথে set-aside ও delay condonation আবেদন করুন।
  4. বিলম্বের কারণ যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করুন — আদালত কারণ না পেলে আবেদন নাকচ করবে।
  5. ব্লগ বা আইনি তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে সর্বদা Order XXII-এর ধারা উল্লেখ করুন — এতে তথ্য আইনি ভাবে সঠিক ও নির্ভরযোগ্য থাকে।

🏁 উপসংহার

কায়মোকাম বা Substitution হচ্ছে বাংলাদেশের দেওয়ানি বিচারব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বাধ্যতামূলক আইনি ধাপ
পক্ষ মারা গেলে সময়মতো কায়মোকাম না করলে মামলা বাতিল হয়ে যেতে পারে, যার ফলে বাদী বা বিবাদীর অধিকার চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে।

তাই একজন সচেতন আইনজীবী বা মামলার পক্ষ হিসেবে এই বিষয়টি সঠিকভাবে জানা ও সময়মতো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য।
বাংলাদেশের দেওয়ানি কার্যবিধি, ১৯০৮-এর Order XXII ও হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা এই বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছে, যা যথাযথভাবে অনুসরণ করলে অপ্রয়োজনীয় মামলা খারিজ বা বিলম্ব এড়ানো সম্ভব।


✍️ লেখক:
অ্যাডভোকেট নাজমুল আলম অপু
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
(আইনি লেখক ও ব্লগার)

Leave a Reply