⚖️ ইলা (Ila) এর ইসলামিক ও আইনি বিশ্লেষণ: বাংলাদেশের পারিবারিক আইন প্রেক্ষাপটে
✍️ নাজমুল আলম অপু
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
আইনি ব্লগার ও লেখক
১️⃣ ভূমিকা
ইসলামী পারিবারিক ব্যবস্থায় ইলা (إيلاء) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা মূলত স্বামীর দ্বারা শপথভিত্তিক দাম্পত্য বিরতি নির্দেশ করে।
অর্থাৎ, স্বামী যদি শপথ করে যে সে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (সাধারণত ৪ মাস) স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করবে না, তবে সেটি ইলা হিসেবে গণ্য হয়।
ইসলামী শরিয়াহতে এটি একটি শর্তাধীন বিচ্ছেদ বা বিবাহবিচ্ছেদের পূর্ব ধাপ হিসেবে বিবেচিত, তবে এটি তালাক নয়।
বাংলাদেশে ইলার কোনো স্বতঃসিদ্ধ তালাক-প্রক্রিয়া নেই; তবে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১–এর আলোকে ইলার প্রভাব ও প্রতিকার স্পষ্টভাবে নির্ধারিত।

২️⃣ ইসলামিক দৃষ্টিতে ইলার সংজ্ঞা ও ভিত্তি
(ক) শরিয়তের সংজ্ঞা
- ইলা হলো: “স্বামী কর্তৃক শপথ গ্রহণ করা যে সে তার স্ত্রীকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত স্পর্শ করবে না বা সহবাস করবে না।”
- কুরআনে আল্লাহ বলেন: “যেসব ব্যক্তি তাদের স্ত্রীদের থেকে ইলা করে (অর্থাৎ সহবাস থেকে বিরত থাকার শপথ নেয়), তাদের জন্য চার মাস সময় রয়েছে; তারপর যদি তারা পুনর্মিলিত হয়, তবে আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।”
— সূরা আল-বাকারা (২:২২৬-২২৭)
এই আয়াতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ৪ মাসের মধ্যে স্বামী যদি স্ত্রীকে গ্রহণ করে, তাহলে ইলা ভঙ্গ হবে;
আর যদি সে না করে, তবে বিচ্ছেদের পথ খুলে যায়।
(খ) ইলার প্রকারভেদ
- ইলায়ে মুআক্কাদ (إيلاء مؤكد):
স্বামী যদি স্পষ্টভাবে বলে যে সে ৪ মাস বা তারও বেশি সময় স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করবে না, এবং তা তালাকের ইঙ্গিতপূর্ণ হয়। - ইলায়ে গাইর মুআক্কাদ (غير مؤكد):
যদি স্বামী কোনো নির্দিষ্ট সময়ের উল্লেখ না করে শুধু শপথ নেয়, তাহলে সেটি অস্থায়ী ইলা হিসেবে গণ্য হয়।
শপথ ভঙ্গ করলে কাফফারা (প্রায়শ্চিত্ত) দিতে হয়।
৩️⃣ বাংলাদেশের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী ইলা
(ক) মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১
যদিও ১৯৬১ সালের এই আইনে “ইলা” শব্দটি সরাসরি উল্লেখ নেই, তবে এর প্রভাব ধারা ৭ ও ৮–এর মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়।
ধারা ৭: তালাকের প্রক্রিয়া ও ইলার প্রভাব
- যদি স্বামী ৪ মাস বা তারও বেশি সময় ধরে স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস থেকে বিরত থাকে এবং কোনো যৌক্তিক কারণ না থাকে,
তাহলে স্ত্রী ফ্যামিলি কোর্টে আবেদন করে “বিচ্ছিন্নতা” চাইতে পারেন। - এই ক্ষেত্রে আদালত তদন্ত করে দেখবে স্বামীর আচরণ ইলা বা মানসিক নির্যাতন–এর অন্তর্ভুক্ত কিনা।
ধারা ৮: ইলা ভঙ্গের প্রতিকার
- স্বামী যদি শপথ ভঙ্গ করে স্ত্রীকে গ্রহণ করে, তবে তাকে ইসলামিক বিধান অনুসারে কাফফারা দিতে হবে।
সাধারণতঃ তিনটি বিকল্পের একটিতে কাফফারা প্রদান করা যায়:- দাস মুক্ত করা (বর্তমানে প্রযোজ্য নয়)
- টানা তিন দিন রোজা রাখা
- দশজন গরিব মানুষকে আহার করানো
📚 রেফারেন্স:
Md. Hasan v. Jebunnesa (1985) 37 DLR 11 – আদালত ইলার শপথ ভঙ্গের পর কাফফারার প্রয়োগের নীতি ব্যাখ্যা করে।
৪️⃣ ইলা থেকে মুক্তির প্রক্রিয়া
(ক) স্বামীর পক্ষ থেকে
- শপথ ভঙ্গ করে স্ত্রীকে গ্রহণ:
চার মাসের মধ্যে স্ত্রীকে স্পর্শ করলে ইলা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভঙ্গ হয়। - তালাক ঘোষণা:
যদি স্বামী চার মাসের মধ্যে স্ত্রীকে গ্রহণ না করে, তবে সে আনুষ্ঠানিকভাবে তালাক দিতে পারে,
তবে তা অবশ্যই মুসলিম পারিবারিক আইন অনুসারে নোটিশের মাধ্যমে হতে হবে।
(খ) স্ত্রীর পক্ষ থেকে
- ফ্যামিলি কোর্টে আবেদন:
মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ধারা ৭ অনুযায়ী, স্ত্রী বিচ্ছিন্নতা (Separation) বা তালাকের ঘোষণা চাইতে পারেন। - খুলা বা ফাসখের আবেদন:
যদি স্বামী ৪ মাসেরও বেশি সময় সম্পর্ক বজায় না রাখে, তবে স্ত্রী খুলা (Khula) বা ফাসখ (Faskh)–এর মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ চাইতে পারেন।
৫️⃣ হাইকোর্টের গুরুত্বপূর্ণ রায়সমূহ
(ক) ইলার মাধ্যমে তালাকের বৈধতা
Begum Rokeya v. Md. Ali (2001) 53 DLR 87:
- আদালত রায় দেন যে, ইলার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তালাক কার্যকর হয় না।
- ইলার কারণে বিচ্ছেদ চাইলে তা অবশ্যই আদালতের মাধ্যমে হতে হবে।
(খ) স্ত্রীর অধিকার ও ভরণপোষণ
Salma Begum v. Abdur Rahim (2015) 67 DLR (HCD):
- আদালত ঘোষণা দেন, ইলার সময়েও স্ত্রী ভরণপোষণ, বাসস্থান ও সন্তানের দায়িত্ব দাবি করতে পারেন।
- ইলার শপথ স্ত্রীর মৌলিক অধিকার খর্ব করতে পারে না।
৬️⃣ পারিবারিক আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট অধিকারসমূহ
(ক) ভরণপোষণ (Maintenance)
- মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১–এর ধারা ৯ অনুসারে,
ইলার সময়েও স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকার রাখেন।
(খ) সন্তানের হেফাজত (Custody)
- গার্ডিয়ানস অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট, ১৮৯০ অনুযায়ী,
ইলার সময় বা পরবর্তী বিচ্ছেদের পর সন্তানদের শ্রেষ্ঠ স্বার্থের ভিত্তিতে আদালত হেফাজতের রায় দেয়।
৭️⃣ প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
❓ ১. ইলা কি তালাকের সমান?
না। ইলা একটি শপথভিত্তিক প্রতিশ্রুতি মাত্র। চার মাস পর এটি স্বয়ংক্রিয় তালাক নয়; বরং আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ কার্যকর হয়।
❓ ২. স্ত্রী কি ইলা করতে পারে?
না। ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী, শুধুমাত্র স্বামীই ইলা করতে পারে।
❓ ৩. বাংলাদেশে ইলা কতটা প্রচলিত?
বর্তমান সমাজে ইলার ব্যবহার খুবই বিরল, তবে এটি ইসলামী শরিয়ত ও বাংলাদেশের পারিবারিক আইনে বৈধ ও স্বীকৃত।
❓ ৪. ইলা ভঙ্গের পরে কী করণীয়?
স্বামী কাফফারা দেবে এবং দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরায় স্থাপন করবে।
৮️⃣ উপসংহার
ইলা হলো ইসলামিক পারিবারিক আইনের একটি অনন্য ধারণা, যা দাম্পত্য জীবনে সমঝোতা, ধৈর্য ও শুদ্ধতার পরীক্ষাস্বরূপ।
বাংলাদেশের আইনি কাঠামো ইলার অপব্যবহার রোধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে — যাতে এটি কখনোই স্ত্রীর প্রতি নির্যাতন বা মানহানির হাতিয়ার না হয়।
অতএব, ইলার প্রয়োগে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি ও দেশের আইন—উভয়ের ভারসাম্য বজায় রাখাই ন্যায়বিচারের মূল লক্ষ্য।
✍️ লেখক:
নাজমুল আলম অপু
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
আইনি লেখক ও ব্লগার