আমেরিকায় নতুন অভিবাসন আইন ও কঠোর নীতিতে বিপাকে হাজারো বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী। জানুন সাক্ষাৎকার বাধ্যতামূলক, ফি বৃদ্ধি ও আশ্রয় প্রক্রিয়ার জটিলতা।
ভূমিকা: নতুন অভিবাসন বাস্তবতায় বাংলাদেশি প্রার্থীদের সংকট

American flag and USA border
যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন সব সময়ই বাংলাদেশিদের কাছে একটি বড় স্বপ্ন। উন্নত জীবন, মানসম্পন্ন শিক্ষা, নিরাপত্তা ও কাজের সুযোগ — এই সবকিছুই হাজার হাজার অভিবাসন প্রত্যাশীকে প্রতিনিয়ত আমেরিকার দিকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু ২০২৫ সালে ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন অভিবাসন নীতি ও আইনি পরিবর্তনের কারণে এই স্বপ্ন এখন অনেকের কাছে দুঃস্বপ্নে পরিণত হচ্ছে।
বর্তমানে হাজারো বাংলাদেশি প্রার্থী ভিসা, গ্রীন কার্ড, কাজের অনুমতি (Work Permit/EAD), আশ্রয় (Asylum) এমনকি ভিসা নবায়ন প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের জটিলতার মুখে পড়েছেন। কঠোর নিরাপত্তা যাচাই, অতিরিক্ত ফি, দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষা, সাক্ষাৎকার বাধ্যতামূলক করা — এই সব পরিবর্তন তাদের অবস্থাকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে।
১. সাক্ষাৎকার বাধ্যতামূলক হওয়ায় ভিসা প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ও USCIS একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি পরিবর্তন করেছে। এখন থেকে সব নন-ইমিগ্রান্ট ভিসা প্রার্থীর জন্য ইন-পার্সন সাক্ষাৎকার (in-person interview) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এর মধ্যে ছাত্রভিসা (F-1), এক্সচেঞ্জ ভিজিটর (J-1), H-1B কাজভিসা ও ডিপেন্ডেন্ট ভিসা অন্তর্ভুক্ত।
পূর্বে অনেক ক্ষেত্রেই interview waiver অর্থাৎ সাক্ষাৎকার ছাড়াই ভিসা ইস্যু করা হতো। কিন্তু এখন এই সুযোগ তুলে দেওয়ায়:
- আবেদনকারীদের অপেক্ষার সময় বেড়ে গেছে
- সাক্ষাৎকারের জন্য ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে
- শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের জন্য ক্লাস বা জব অফার মিস করার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে
একজন আবেদনকারীকে এখন গড়ে ৬ থেকে ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে সাক্ষাৎকারের জন্য। এতে অনেকেই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভ্রমণ বা যোগদান করতে পারছেন না।
২. H-1B ভিসায় $100,000 অতিরিক্ত ফি: বড় ধাক্কা বাংলাদেশিদের জন্য
H-1B কাজভিসা বাংলাদেশের টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিকেল খাতের অনেক প্রার্থীর জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় ভিসা। কিন্তু নতুন প্রশাসনের আদেশে এখন নতুন H-1B ভিসা আবেদনে এককালীন $100,000 অতিরিক্ত ফি দিতে হচ্ছে চাকরিদাতা কোম্পানিকে।
👉 এর ফলে:
- ছোট ও মাঝারি কোম্পানিগুলো বিদেশি কর্মী নেওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাচ্ছে
- আবেদনকারীর জন্য সুযোগ কমে যাচ্ছে
- অনেক প্রার্থীকে অন্য ভিসা ক্যাটাগরির দিকে ঝুঁকতে হচ্ছে
এই সিদ্ধান্তকে ইতোমধ্যেই একাধিক ইমিগ্রেশন সংগঠন আদালতে চ্যালেঞ্জ করেছে, তবে এই মুহূর্তে এটি কার্যকর রয়েছে।
৩. বায়োমেট্রিক্স ও নিরাপত্তা যাচাই আরও কঠোর হচ্ছে
২০২৫ সালে USCIS ঘোষণা দিয়েছে, এখন থেকে অভিবাসন প্রক্রিয়ায় শুধুমাত্র ফিঙ্গারপ্রিন্ট নয়, আইরিস স্ক্যান, পাম প্রিন্ট, ভয়েস প্রিন্ট এমনকি DNA স্যাম্পল পর্যন্ত নেওয়া হতে পারে।
এছাড়াও, অনেক প্রার্থীর ব্যাকগ্রাউন্ডে continuous vetting system চালু করা হচ্ছে — অর্থাৎ অভিবাসনের আবেদন করার পরও নিয়মিত তাদের কার্যক্রম নজরদারি করা হবে।
👉 এই প্রক্রিয়ায়:
- আবেদন অনুমোদন পেতে সময় অনেক বেশি লাগছে
- কিছু আবেদন “security review” এর কারণে বছরের পর বছর ঝুলে আছে
- অনেকে কাজ হারাচ্ছেন কারণ সময়মতো EAD বা ভিসা নবায়ন হচ্ছে না
৪. কাজের অনুমতিপত্র (EAD) নবায়নে দীর্ঘ বিলম্ব
বাংলাদেশি অনেক অভিবাসন প্রত্যাশী আশ্রয় বা ছাত্র ভিসা থেকে EAD (Work Authorization) নিয়ে কাজ করেন। কিন্তু গত এক বছরে EAD নবায়নে রেকর্ড সংখ্যক আবেদন জমে গেছে।
ফলে:
- অনেকে কাজ হারাচ্ছেন কারণ পুরনো EAD মেয়াদ ফুরিয়ে যাচ্ছে
- অনেক প্রতিষ্ঠান নতুন কর্মী নিতে দ্বিধায় পড়ছে
- USCIS বাধ্য হয়ে ১৮ মাসের অটো এক্সটেনশন (540 দিন) ঘোষণা করেছে, কিন্তু তাতেও জট কমছে না
এই পরিস্থিতিতে অনেক বাংলাদেশি আবেদনকারী বেকার হয়ে পড়ছেন এবং আর্থিক সমস্যায় পড়ছেন।
৫. আশ্রয় (Asylum) আবেদনকারীদের জন্য সংকট আরও গভীর
বাংলাদেশ থেকে আসা অনেক অভিবাসী রাজনৈতিক বা সামাজিক কারণে যুক্তরাষ্ট্রে Asylum আবেদন করে থাকেন। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর নীতিতে:
- আশ্রয়ের নতুন আবেদন সীমিত করা হয়েছে
- পূর্বের অনেক ফাইল স্থগিত বা বাতিল হচ্ছে
- Hearing-এর জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে (৩–৫ বছর পর্যন্ত)
- কিছু আবেদনকারীকে detention center এও পাঠানো হচ্ছে
এই অবস্থায় অনেক বাংলাদেশি পরিবার ভিসা বা স্ট্যাটাসহীন অবস্থায় বাস করছেন — যা ভবিষ্যতে আরও বড় আইনি জটিলতার সৃষ্টি করছে।
৬. নতুন নীতিতে নাগরিকত্ব পাওয়াও কঠিন হয়ে উঠছে
আমেরিকার নাগরিকত্ব পেতে সাধারণত পাঁচ বছর স্থায়ীভাবে বসবাস, ভাষা পরীক্ষা, নাগরিকত্ব পরীক্ষা এবং “good moral character” প্রমাণ করতে হয়।
নতুন নীতিতে আবেদনকারীদের উপর “anti-Americanism” screening বা রাষ্ট্রবিরোধী মতাদর্শ যাচাই প্রক্রিয়া চালু হচ্ছে।
👉 এই অস্পষ্ট ধারা অনেককে অপ্রত্যাশিতভাবে Reject করছে।
বাংলাদেশ থেকে আগত অনেক আবেদনকারী এখন নাগরিকত্ব প্রক্রিয়ায় অযৌক্তিক বিলম্ব ও জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হচ্ছেন।
৭. ভিসা সেবা ও প্রক্রিয়ায় ঢাকায়ও পরিবর্তন
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস ভিসা সেবা প্রক্রিয়ায় কিছু নতুন নিয়ম চালু করেছে:
- সাক্ষাৎকার অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য অনলাইন প্রি-রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক
- অতিরিক্ত ডকুমেন্ট যাচাইয়ের জন্য দ্বিতীয় ধাপের ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া
- রিজেকশনের ক্ষেত্রে reapply এর সময়সীমা কমানো
এই পরিবর্তনে ভিসা পাওয়া আরও সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়েছে।
৮. বাংলাদেশিদের করণীয়: আইন জানা ও প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি
এই পরিস্থিতিতে আইন জানা এবং সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীদের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা হতে পারে:
✅ অভিবাসন নীতির নিয়মিত আপডেট জানা (USCIS, DOS ওয়েবসাইট)
✅ পেশাদার আইনজীবীর সঙ্গে প্রাথমিকভাবে পরামর্শ করা
✅ ডকুমেন্ট ও কাগজপত্র সঠিক ও সময়মতো জমা রাখা
✅ ভিসা ও স্ট্যাটাস নবায়নের তারিখ আগেভাগে জানা ও আবেদন করা
✅ সম্ভাব্য বিকল্প ভিসা ক্যাটাগরি বিবেচনা করা (যেমন: L-1, O-1)
৯. আইনজীবীর দৃষ্টিকোণ থেকে সতর্কবার্তা
একজন পেশাদার আইনজীবী হিসেবে আমি দৃঢ়ভাবে বলব — ২০২৫ সালের বর্তমান অভিবাসন নীতিতে অবহেলা বা অজ্ঞতা খুব বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে।
অনেকে সময়মতো রিনিউ না করায় বা ভুল তথ্য দেওয়ায় স্থায়ীভাবে স্ট্যাটাস হারাচ্ছেন।
📌 তাই:
- কোনো নোটিশ পেলে দ্রুত উত্তর দিন
- প্রয়োজন হলে Appeal বা Motion to Reopen করুন
- অবৈধ উপায়ে স্ট্যাটাস পাওয়ার চেষ্টা করবেন না — এতে ভবিষ্যতের নাগরিকত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
উপসংহার: অনিশ্চয়তার মাঝেও আশার আলো
আমেরিকায় অভিবাসন আইন কঠিন হচ্ছে — কিন্তু অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে না। সচেতন, সময়োপযোগী ও আইনসম্মত পদক্ষেপ নিলে বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীদের জন্য এখনও অনেক সুযোগ রয়েছে।
বর্তমান প্রশাসনের নীতিতে অনেক জায়গায় আইনি চ্যালেঞ্জ ও পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে, তাই হাল না ছেড়ে নিয়মিত আপডেট রাখা এবং সঠিক আইনি সহায়তা নেওয়াই হতে পারে সাফল্যের চাবিকাঠি।
লেখকঃ-
নাজমুল আলম অপু
এডভোকেট
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
মোবাইলঃ ০১৬৮০১৯১৯৯১,০১৭১৫৯৯০৭৪১।